Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

জিরো টলারেন্স!

রুমীন ফারহানা
প্রকাশিত: ২২:২০, নভেম্বর ২০, ২০১৬ |সর্বশেষ আপডেট: ২১:৪৬, নভেম্বর ২৪, ২০১৬
আজকাল প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়। সরকার প্রধান বলেন, সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বলেন, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখেও শোনা যায়—জিরো টলারেন্স। যার সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় কোনও অবস্থাতেই বরদাস্ত করা হবে না। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি বা সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে যখন কথাটি উচ্চারিত হয়, তখন জনমনে এক ধরনের স্বস্তি হয়তো বা ফিরে আসে। যাক সরকার সজাগ আছে, ন্যূনতম কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধী যেই হোক, তাকে ধরা হবে, বিচারের আওতায় আনা হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক এমন শাস্তি নিশ্চিত করা হবে, যেন ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ করার আগে মানুষ দশবার চিন্তা করে। অর্থাৎ সার্বিক অর্থে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষ ন্যায়বিচার পাবে।
কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? ঘটনা ঘটে, সংবাদপত্রের বড় কলামজুড়ে ছবিসহ খবর বের হয়, দুই-চারদিন তার আপডেট পায় মানুষ, উদ্বিগ্ন হয়, বিচার চায়, টকশো'র টেবিলে ঝড় ওঠে, তেমন তেমন ঘটনা হলে সভা সমাবেশ, মানববন্ধনও হয় কখনও-সখনও। এরপরই নতুন আর একটি ঘটনা এসে ধুয়েমুছে দিয়ে যায় আগের সবটুকু। যেন ঘটনাটি ঘটেইনি কোনও দিন। যেমন আজকাল মনে হয় সাগর রুনিকে কেউ হত্যা করেনি, বিশ্বজিৎ বলে কেউ কখনও কোথাও ছিল না, ত্বকী, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, তনু, মিতু, রিসা, আফসানা, খাদেজা বা নাম ভুলে যাওয়া আরও অনেকে বাস্তব কোনও চরিত্রই নয়। তনুর ঘটনাটি বিশেষভাবে মনে পড়ে। কত আন্দোলন, কত বিক্ষোভ, সভা সমাবেশ, বিচার চাওয়া এবং না পাওয়া। তনুর মায়ের সেই বুক হিম করা অসহায় আর্তনাদ 'ওরা আমারে এই সব কী জিগায়? কেন জিগায়?' তনুর মা স্পষ্ট বললেন কাদের সন্দেহ করেন তিনি। সবাই বধির হয়ে রইলো, আমরা সবাই নিশ্চিন্ত থাকলাম এই ভেবে, যাক তনুতো আর আমার কেউ নয়। সবই ঘটলো জিরো টলারেন্সের মধ্যেই।  
এখন আর মনে হয় না ২০১৩ থেকে জিরো টলারেন্সের মধ্যে ঘটে যাওয়া শ' খানেক জঙ্গি হামলা দেখেছে এদেশের মানুষ। অভিজিৎ, দীপন, রাজীব হায়দার, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, অনন্ত বিজয় দাস বা ওয়াশিকুর রহমান বাবুরা তো কবেই নাই হয়ে গেছে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনার অন্তরালে। রাজনৈতিক কোন্দলে মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হলো শিশু, এমপি সাহেব মাতাল অবস্থায় গুলি চালানো প্র্যাক্টিস করলেন ৭ বছরের শিশুর পায়ে, এমপিপু্ত্র জ্যামের জ্বালায় অস্থির হয়ে গুলি চালালেন রিকশা চালকের গায়ে। আর এক এমপি আত্মীয় স্বজনসহ প্রথম হলেন ইয়াবা, মানবপাচার আর মাদকের ব্যবসায়। তবে কোন মন্ত্রী, এমপির বিরুদ্ধে মামলা হয়নি একথা বললে ভুল হবে। হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে হয়েছে, গর্বসহকারে জামিন নিয়ে বের হয়ে এসেছেন তারা, সাজার রায়ও হয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ঠিক যেন exception proves the rule এর মতো, তবে শপথ থেকে বিচ্যুতি ঘটলেও স্বপদ থেকে সরতে হয়নি তাদের কাউকেই। এত ঘটনা এত এত বেশি ঘটনা, যেন একটির কবর রচনা করছে আর একটি। কোনটি রেখে কোনটি বলি? আর সবই ঘটছে জিরো টলারেন্সের মধ্যেই।

সম্প্রতি নাসিরনগর আর গোবিন্দগজ্ঞে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে উত্তাল হয়ে আছে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ দেশের আপামর জনসাধারণ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে এ কেমন ঘটনা? ১৫টি মন্দির ভাঙলো, শ’ খানেক হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়া হলো। একবার বা দু’বার নয় থেকে থেকে চারবার আগুন দিয়ে পোড়ানো হলো হিন্দু ঘরবাড়ি। নাসিরনগরের ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে প্রতিমা ভাঙচুর হলো ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা, বরিশালের বানরীপাড়া আর নেত্রকোনার কলমাকান্দাসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থানে। তদন্তে প্রকাশ পেলো এসব কিছুর পেছনে কাজ করেছে রাজনীতির ঘৃণ্য কৌশল, সরকার এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা, ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং দীর্ঘদিন লালিত বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সুশাসনের অভাব। বহিষ্কার করা হলো আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে কিন্তু গ্রেফতার হলেন বিএনপি'র নেতা আমিরুল হোসেন, যাকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এমনকি তার পক্ষে লিখিত আবেদনও জমা দিয়েছেন হামলার ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলার বাদী। মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল চন্দ্র চৌধুরী এবং উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিপদ পোদ্দার একটি  দৈনিকের কাছে এও বলেছেন যে, ঘটনার দিন আমিরুল তাদের কোনও ক্ষতি করেননি বরং বাড়িঘর রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তাকে গ্রেফতারের ঘটনা দুঃখজনক। কিন্তু তাদের কথা শুনছে কে? নিজের লোককে আড়াল করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে বিরোধীপক্ষের নির্দোষ কর্মীকে ফাঁসানো এ সবই তো রাজনীতির অংশ। এসবই জিরো টলারেন্স।
যারা ২০০১ সাল ছাড়া আর কখনও কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতন দেখতে নারাজ, তাদের একটু মনে করিয়ে দেই—২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায়, ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল কুমিল্লার হোমনায় এবং ৫ জানুয়ারি যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ায় ক্ষমতাসীন দলের হাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নৃশংস হামলা হয়েছে, তার সঠিক বিচার হলে হয়তো নাসিরনগরে একই কায়দায় এই ঘটনা ঘটানোর সাহস পেতো না দুর্বৃত্তরা। যারা চিরকালই ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে, হৃষ্টপুষ্ট হয়। জানে যে, কোনও কিছু করা যায়, করে পার পাওয়া যায়, যতই জিরো টলারেন্স থাক না কেন। জিরো টলারেন্স সাধারণ মানুষের জন্য, ভিন্ন মত, ভিন্ন দল, ভিন্ন আদর্শের জন্য। ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশের সাধ্য তার নাই।
নাসিরনগর পুড়তে না পুড়তেই আগুন জ্বলে উঠলো গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পাড়ায়। সাঁওতালরা উচ্ছেদ হলো, জীবন আর সহায় সম্বল হারালো, নিজ জমিতে বোনা ফসল কেটে নিয়ে গেল দেশিবর্গীরা। সাঁওতালদের আনলেন যারা, উচ্ছেদেও অগ্রণী তারা। অনুসন্ধানে দেখা গেল যাবতীয় গোলমালের মূলে রয়েছে গত ইউপি নির্বাচনে ভোটের রাজনীতি আর একটি প্রভাবশালী মহলের ভূমি দখলের জন্য সাঁওতালদের প্ররোচনা দেওয়া। আবারও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নাম উঠে এলো। কিন্তু প্রথম চোটেই মামলা দেওয়া হলো সাঁওতালদের নামে। কোমরে দড়ি আর হাতে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় হাসপাতালে আশ্রয় নিলো স্বজন আর সম্পদ হারানো আহত সাঁওতালরা। শেষমেষ অবশ্য সাঁওতালদের মামলা নিলো পুলিশ। তবে তা ঘটনা ঘটার ১১ দিন পরে।
জিরো টলারেন্স আসলে কী? কাদের রক্ষা করার জন্য?  কাদের ওপরই প্রযোজ্য? এটা কি শুধুই বলার জন্য বলা একটি মিথ? প্রশ্নগুলোর উত্তর যাই হোক না কেন, দেশের সার্বিক মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিন্তু স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, দেশে নিরাপদ বলয়ে বাস করা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ক্ষমতার কাছাকাছি বাস করার সুবাদে যারা কিছুটা নিশ্চিন্তে ছিলেন, তারাও বোধ করি ধীরে-ধীরে উপলব্ধি করছেন সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো না গেলে প্রত্যেকেরই নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। আজ যারা এই ভেবে স্বস্তিতে আছেন যে, তনু, মিতু বা বিশ্বজিৎ তাদের কেউ নন, তাদের বলে রাখি—কাল যে, ঠিক একই পরিণতি আপনার বা আপনার স্বজনের ভাগ্যে ঘটবে না, তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না।

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment