Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

গোবিন্দগঞ্জে ইক্ষু খামারের জমি ঘিরে মহাপরিকল্পনা

১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ 
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের সেই জমি ঘিরে গ্রিন প্রকল্প করার উদ্যোগ নিয়েছে রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ জমিতে ইকো পার্ক, পাঁচতারা ও চারতারা সমমানের একাধিক মোটেল, বিদেশে রপ্তানির জন্য মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিসেস নামের মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে চীনের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের চার প্রকৌশলী গত আগস্টে ইক্ষু খামার এলাকা ঘুরে গেছেন। রংপুর চিনিকলের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। রংপুর চিনিকলের আওতায় সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খমারে জমির পরিমাণ এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের শর্ত লঙ্ঘন করেছে—এমন অভিযোগে স্থানীয় সাঁওতাল সম্প্রদায় ওই জমির মালিকানা দাবি করে আন্দোলন করছে। গত জুলাইয়ে সাঁওতালরা ইক্ষু খামারের জমিতে বসতি গড়ে তোলে। গত ৬ নভেম্বর তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল নিহত হয়। সেদিন দুর্বৃত্তরা সাঁওতালদের বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং তাদের সব মালপত্র লুট করে নিয়ে যায়। উচ্ছেদের পর অসহায় লোকজন পাশের সাঁওতালপল্লীতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আর নতুন করে আখ চাষ শুরুর কথা বলে খামারের জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলেছে মিল কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত মে মাসে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিনিকলের জমি অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত দেখিয়ে সেখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে অবশ্য গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ জানান যে ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইক্ষু খামারের জমিতে ইকো পার্ক, মোটেল, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট, পর্যটন এলাকাসহ বহুমুখী প্রকল্পের প্রস্তুতি চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৬২৩ কোটি টাকা। পরে এ খরচ আরো বাড়তে পারে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ তাদের তত্ত্বাবধানে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
এ বিষয়ে রংপুর চিনিকলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) জাহিদ আনসারী কালের কণ্ঠকে জানান, এত দিন জমিগুলো (এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর) ব্যবহার না করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। পড়ে থাকা জমিতে ইজারাদাররা বিভিন্ন ফসলের আবাদ করছিল। একই অবস্থা ছিল এ জমিতে থাকা বেশ কিছু পুকুরের ক্ষেত্রে। এখন এসব জমি-পুকুর পরিকল্পনামতো কাজে লাগানো হবে। এরই মধ্যে গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিসেস নামের প্রকল্পে একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁর তত্ত্বাবধানে খামারের ভেতরে পুকুর খনন ও পাড় বর্ধনের কাজ চলছে।
সাঁওতালদের দাবি, চিনিকলের এসব জমি ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের। রংপুর চিনিকলের জন্য সাহেবগঞ্জের এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের চুক্তি হয়। এর ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, জমিগুলো শুধু রংপুর চিনিকলের আখ চাষের জন্যই ব্যবহৃত হবে। এ জমিতে আখ চাষ না করা হলে ভবিষ্যতে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন জমি সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে এবং সরকার মালিকদের কাছে জমি ফিরিয়ে দেবে। মাঝে লোকসানের কারণে সাময়িকভাবে চিনিকলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সেখানে আবাদযোগ্য দেড় হাজার একরের পুরোটাই অন্য ব্যক্তিদের কাছে ইজারা দেয়। ইজারারদারা সেখানে ধান, পাট, তামাক, সরিষাসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছে। এ ছাড়া খামারের জমিতে অন্তত ১২টি পুকুর খনন করা হয়েছে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করায় জমি ফেরতের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছে সাঁওতালরা।
গত মার্চে গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিসেস নামে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মৎস্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন আকরাম হোসেন। তিনি জানান, চিনিকলের গ্রিন প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে খামারের ভেতরে থাকা আট থেকে ১৬ বিঘার বিস্তৃত পুকুর বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুসারে খামারের মধ্যে এ ধরনের পুকুর করা হবে ২৬টি। এসব পুকুরে উৎপাদিত মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। স্বাভাবিক কারণে এখানে ফিশ প্রসেসিং প্লান্টও থাকছে। একটা একটা করে প্রজেক্ট বাড়বে। প্রথমে মাছ চাষ, পরে ফিশ ফিড মিল (মাছের খাবারের জন্য) করা হবে। এরপর বসবে ফিশ প্রসেসিং (রপ্তানির জন্য মাছ প্রক্রিয়াকরণ) প্লান্ট।
রংপুর চিনিকলের জেনারেল ম্যানেজার (ফিন্যান্স) নাজমুল হুদা বলেন, চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অবহেলিত এ অঞ্চলটি যাতে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে লক্ষ্যেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখানে চীনের কারিগরি সহায়তায় পুকুরের ওপর দিয়ে কেবল কার থাকবে। নিচে ফলদ গাছ লাগানো হবে বনভূমি আকারে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণে ও তাদের থাকার সুব্যবস্থার জন্য তারকা মানের মোটেল থাকবে একাধিক। ৬২৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অবহেলিত এ অঞ্চলের দুর্নাম ঘুচবে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিসেস প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন প্রকল্পে সাত কোটি ৭৬ লাখ, ফিশারিজ অপারেশনাল প্রকল্পে এক কোটি ৮৭ লাখ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সড়ক তৈরিতে দুই কোটি এবং প্রকল্পের অন্য আনুষঙ্গিক কাজে ৫৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ৬২৩ কোটি টাকার প্রকল্পের বাইরে রয়েছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এর জন্য সম্ভাব্য বাজেট এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিসেস প্রকল্পের মৎস্য কর্মকর্তা আকরাম হোসেন বলেন, ‘এখন আমাদের লক্ষ্য হলো সাঁওতালদের কাজে যুক্ত করা। তাদের বোঝাচ্ছি, এ খামার আসলে তাদের খামার। জমি বড় কথা নয়, খামার রক্ষা করাই বড় কাজ। পুকুর সংস্কারে, ফলদ বাগান, আখের বীজ লাগানোতে, ফসল কাটতে তাদের ধাপে ধাপে যুক্ত করার কাজ চালাচ্ছি। এখন তারা এটি না মানলে বাধ্য হয়ে বাইরের শ্রমিককে কাজে লাগাতে হবে। ’
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি আদিবাসী নেতা ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘আমরা দেখেছি ওই জমিতে মিলের জন্য ইক্ষুু চাষ না করে ধান ও তামাক চাষ চলছে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনও মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। মিল চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এরপর এখন নতুন করে গ্রিন প্রজেক্ট হচ্ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা আসলে যেকোনো মূল্যে জমি দখল নিতে চাচ্ছে। ইক্ষু চাষ একটা ফন্দি মাত্র। ’
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, এখনো গ্রিন প্রজেক্টের কাগজপত্র তিনি হাতে পাননি। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা নেওয়ার কথা শুনেছেন।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের এক হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ (চুক্তিনামা) করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। চুক্তির শর্তে উল্লেখ আছে, এসব জমি অধিগ্রহণ করা হলেও কখনো যদি ওই কাজে জমি ব্যবহার করা না হয়, তাহলে অধিগ্রহণকৃত জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে। পরে সরকার জমি আগের মালিকের কাছে ফেরত দেবে। এখন অর্থের অভাবে যারা চাষাবাদ করতে পারে না, সেই চিনিকল এ মহাপরিকল্পনা (গ্রিন প্রজেক্ট) গ্রহণ করে কিভাবে? আসলে সাঁওতালদের গুলি করে মারা তাদের এ দখলপ্রক্রিয়ার একটি অংশ ছিল মাত্র। আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নেব। ’
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/12/01/435630

Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment