প্রকাশ : ০৬ মার্চ, ২০১৪
উদার মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ হোক
আবু সাঈদ খান
কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নয়, জাতির মানস গঠনেও প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। নিশ্চয়ই এ কথা নিয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না। কিন্তু বাস্তবে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠক্রম নিয়ে ভিন্ন মতের সুযোগ আছে। কিন্ডারগার্টেন বা কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম নিয়ে মাঝে মধ্যে লেখালেখি হয়, কিন্তু মূলধারার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রম নিয়ে তেমন কথাবার্তা শুনি না। এটি আমাদের অনেকেরই অজানা যে, সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে?মনে পড়ে, আমাদের স্কুলজীবনে (পঞ্চাশ-ষাটের দশক) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে একটি নিবন্ধ ছিল। সেখানে জিন্নাহ তার এক সহপাঠীর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। বন্ধু পেছনে ফিরে দেখেন কিছুদূর এসে জিন্নাহ উল্টো দিকে দৌড়াচ্ছেন। এভাবেই দৌড়িয়ে সূচনাস্থলে ফিরে গেলেন। তার সহপাঠী ফিরে এলে জিন্নাহ বললেন, 'তুমি তো বলনি কোন পর্যন্ত দৌড়াতে হবে। তাই আমি দৌড়িয়ে আগেই এখানে এসেছি। অতএব তোমার হার, আমার জিত।' এটিকে বুদ্ধিমত্তার বিজয় বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন উঠেছিল এটি বুদ্ধিমত্তা, না ধূর্তামি।
শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ওপর লেখা ছিল। তাতে তার আম খাওয়া ও ঘুষি দিয়ে নারিকেল ভাঙার গল্প প্রাধান্য পেয়েছিল। গণিত বইয়ে দুধে পানি মিশিয়ে লাভ করার অঙ্ক ছিল। এসবের যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে কথা উঠেছিল। এখনকার প্রাথমিক পাঠক্রমে (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী) এ ধরনের ত্রুটি চোখে পড়ে না। বরং জাতীয় চেতনা ও নীতি-নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য রচনা ও সম্পাদনায় যুক্ত লেখক-গবেষকদের ধন্যবাদ। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সংকীর্ণতা পরিলক্ষিত।প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইটি হাতে নিয়ে ভালো লেগেছে। পাঠ-৫৬ 'মুক্তযোদ্ধাদের কথা' অংশে আছে_ 'বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালিরা সাড়া দিল।' অর্থাৎ পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালিরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, বাঙালির পাশাপাশি সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, চাকমা, মারমারাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে।এটি সত্য যে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা নতুন আঙ্গিকে মুক্তিসংগ্রামের সূচনা করেছে। তবে এ সংগ্রাম থেকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী দূরে থাকেনি। একাত্তরে এসে সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি-আদিবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সব ধর্মের, সব জাতির, সব মানুষের যুদ্ধ। সেটিকে কেবল বাঙালির যুদ্ধ বলার মধ্যে জাত্যভিমান আছে, যা বৃহত্তর জাতীয় সংহতি রচনার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর।ভেবে দেখুন, চাকমা, সাঁওতাল বা অন্য আদিবাসী শিশু এ অধ্যায়টি যখন পড়বে, তখন তাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হবে? তাদের মনে হবে_ মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালির যুদ্ধ। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা এবং 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ বারবার এসেছে। কিন্তু বর্ণিত ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতাকে ধারণ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালির যুদ্ধ বলেই তুলে ধরা হয়েছে। তবে চতুর্থ শ্রেণীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' বইয়ে আদিবাসীদের অংশগ্রহণের কথা আছে এভাবে_ বাঙালিদের পাশাপাশি এ দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ ধরনের উপস্থাপনায় তাদের ভূমিকার অবমূল্যায়নের সুযোগ থেকে যায়।তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে 'আমাদের জাতির পিতা' নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ সূচনার কথা আছে, '১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কথা আছে।' তারপর বলা হয়েছে_ 'বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।' এটি সত্য, মুজিব মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। তিনি ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা। কিন্তু তার অবর্তমানে তাজউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বের হাল ধরেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সেসব না উল্লেখ করে 'বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়' বলার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না। এ অসম্পূর্ণতা বিভ্রান্তিরও জন্ম দেয়।চতুর্থ শ্রেণীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' গ্রন্থের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ে আছে, '২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।' এটি যৌক্তিক। এর পরের প্যারায় 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। এই সরকার মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত।' কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে কে রাষ্ট্রপতি হলেন, কে প্রধানমন্ত্রী হলেন_ তা নিয়ে কিছু নেই। এটি ত্রুটি, না অন্য কিছু_ তা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। পঞ্চম শ্রেণীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নাম উল্লেখ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে যে, এটি জানার জন্য শিক্ষার্থীদের কি এক বছর অপেক্ষা করতে হবে? এখানে মুক্তিযুদ্ধে আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে 'কাদেরিয়া বাহিনী' ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নেতৃত্বে 'মায়া বাহিনী'র উল্লেখ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বাইরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর নাম না থাকার অর্থ বোধগম্য নয়।লক্ষণীয় যে, পঞ্চম শ্রেণীর 'আমাদের মুক্তিযুদ্ধ' অধ্যায়ে জেড ফোর্স, কে ফোর্স, এস ফোর্সের অধিনায়কদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফের কথা বলা হয়েছে। তবে অধিনায়কদের নাম বলা হয়নি। অথচ এর চার অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ কেবল বিএলএফের (মুজিব বাহিনী) অধিনায়কই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধ সূচনা পর্বেও তাদের ভূমিকা অসামান্য।এ অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নামগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় কি আপত্তি ছিল? এ প্রসঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা উল্লেখ করতে হয়। '৭০-এর নির্বাচনের পর থেকেই যে প্রতিরোধ সংগ্রাম সূচনা হয়, তিনি তার অন্যতম দিকপাল। কিন্তু এসব পাঠ্যবইয়ে তার নাম নেই। শুধু ইতিহাসের অধ্যায়েই নয়, বাংলা বইয়েও তার ওপর নিবন্ধ থাকতে পারে। আমাদের মনে রাখা দরকার, ধারাবাহিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে তা আলাদা করার সুযোগ নেই। তাই বিভিন্ন পর্বের নায়কদের যথাযোগ্য মর্যাদায় পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত।এটি প্রশংসনীয় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-সংগ্রাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একই বিবেচনায় পাঠ্যবইয়ে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখকে তুলে ধরলে শিক্ষার্থীরা আরও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠত।প্রাথমিক পাঠক্রমে নানা ক্ষেত্রের কীর্তিমানদেরও তুলে ধরার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা পাঠক্রমে নজরুল, বেগম রোকেয়ার জীবনী আছে, রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত। কী যুক্তি দেবেন কর্তৃপক্ষ? সব শ্রেণীতে সবার জীবনী দেওয়া সম্ভব নয়, তবে বিভিন্ন শ্রেণীর বইয়ে পরিকল্পনামাফিক জাতির নায়ক ও বীরদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়।পাকিস্তান আমলে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষা বোর্ড মুক্ত হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে ধরা যাক, চতুর্থ শ্রেণীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' বইয়ে 'আমাদের সংস্কৃতি' অধ্যায়ে আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতির কথা নেই। 'বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা' শিরোনামে আলাদা অধ্যায় আছে। পঞ্চম শ্রেণীর 'বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়' বইয়েও 'বাংলাদেশের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতি ও তাদের সংস্কৃতি' শিরোনাম আছে। এসব কিছু বলে দেয় যে, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মূলধারায় স্থান নেই। এখন কি হতে পারত না, 'বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি'। সেখানে বাঙালি ও অন্যান্য জাতিসত্তা সম্পর্কে একইভাবে উপস্থাপন হলে তা হতো বৃহত্তর জাতীয় সংহতির পরিচায়ক।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচটি শ্রেণীর বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, সংশ্লিষ্টরা উদার অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তার পরিচয় দিতে পারেননি। মনে হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে পুরনো বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছেন। লক্ষ্য করা যায়, ইতিহাসের ক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশের ধর্মীয় বিভাজনধারা পরিহার করেছেন। কিন্তু সুসমন্বিতভাবে উপস্থাপিত হয়নি। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে ও তার জানার পরিধিকে বিস্তৃত করার জন্য পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল_ সে ক্ষেত্রে ব্যত্যয় রয়েছে।ইংরেজি বইগুলোকে ভাষা শেখার মাধ্যম বিবেচনা করা হয়েছে। এ বইগুলোর মাধ্যমেও দেশ ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস থাকতে পারত।প্রাথমিক শিক্ষাকে (যা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত নয়, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হওয়াই যুক্তিযুক্ত) কেবল বানান-অঙ্ক-ভাষা শেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতীয় মানস গঠনের দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন।
0 comments:
Post a Comment