“হামরা তো বলে
দিছি, দরকার হয় গাছের পাতা খেয়ে থাকিবো, মাটি খাইবো, কিন্তু জমি ছাড়বো
না” কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে জয়পুর সাঁওতাল পল্লীতে
প্রশাসনের উচ্ছেদে ভিটেমাটি ছাড়া খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা রত্না। গত
শনিবার ঢাকা থেকে একটি দল তাদের খোঁজখবর নিতে ও ত্রাণ দিতে গেলে এই কথা
বলেন তিনি।
গত ৬ নভেম্বর
রংপুর চিনিকলের অধিকৃত জমি থেকে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেয়
চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারীরা। এসময় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ তাদের সহযোগিতা
করে, সাঁওতালদের উপর গুলি চালায় বলেও অভিযোগ উঠেছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে
তাদের ঘরবাড়ি, এমনকি ট্রাক্টর চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে সেসব
ভিটেমাটির শেষ অস্তিত্বটুকুও। এক মাসের শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ
পর্যন্ত সকলেরই এখন জায়গা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে।
এই নিঃস্ব
হওয়া সাঁওতালদের বর্তমান অবস্থা সচক্ষে দেখতে এবং তাদের সহযোগিতা করতে গত
১৯ নভেম্বর, শনিবার ঢাকা থেকে একটি দল বিভিন্ন ত্রাণ নিয়ে গোবিন্দগঞ্জের
মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে যায়। এই দলে ছিলেন সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু
খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা জাকিয়া শিশির, ইউনাইটেড
কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু, সাবেক ছাত্রনেতা
আকরামুল হক, সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি ও তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ
বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ উদীচী
শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাংবাদিক সাকিল অরণ্য, কৃষক সমিতির নেতা ও
সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা মানবেন্দ্র দেব, ক্ষেতমজুর সমিতির নেতা ফেরদৌস
আহমেদ উজ্জ্বল, নাগরিক সংহতির শরীফুজ্জামান শরীফ, কমিউনিস্ট নেতা তারিক
হাসান মিঠুল, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের আইন বিষয়ক সম্পাদক খান শিমুল, নারী
বিষয়ক পত্রিকা জাগরণীয়া ডট কম এর সম্পাদক ও অ্যাক্টিভিস্ট প্রকৌশলী শুভ্রা
কর, অ্যাক্টিভিস্ট সঙ্গীতা ঘোষ, রাজনৈতিক কর্মী মেরিলিনা সরকার,
অ্যাক্টিভিস্ট দিদারুল ভূঁইয়া প্রমুখ।
ভোরে যখন এই
দলটি গাইবান্ধা পৌঁছায় বাইরে তখন কনকনে শীত। যাওয়ার পথেই চোখে পড়ে কাঁটাতার
দিয়ে আটকানো ধানক্ষেত। বাসনকোসন, চালডাল, কম্বল, শীতবস্ত্র ও কিছু পোশাক
নিয়ে সকাল ১০টা নাগাদ দলটি গোবিন্দগঞ্জের মাদারপুর গ্রামে পৌঁছায়। সরেজমিনে
গিয়ে দেখা যায়, এই শীতেও খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন আবালবৃদ্ধবনিতা
সবাই। খোলা জায়গাতেই তৈরি করা হয়েছে কিছু মাটির চুলা। তাতে চলছে রান্না।
আয়োজন সামান্যই। ভাত, ডাল। কারো ভাগ্যে ডালও নেই, শুধুই ভাত।
সেখানে
উপস্থিত কিছু স্বেচ্ছাসেবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরিস্থিতি এখনো থমথমে।
বিভিন্ন সংগঠন কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব খাবার আসে তাই দিয়ে এদের জীবন
চলছে।
মাদারপুর
গ্রামে ঘুরে ঘুরে দেখা যায় সেখানে খোলা আকাশের নিচে এক মাসের শিশু থেকে
শুরু করে রয়েছেন প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধরাও। পাড়ার বাইরে কোথাও যাওয়ার সাহস করতে
পারছেন না তারা এখনো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি গোষ্ঠী যা দিয়ে যাচ্ছেন
তাই দিয়ে কোনরকমে সবাই মিলে খেয়েপরে চলছে তাদের।
দুই সন্তানের
জননী মাদারপুর গ্রামের কবিতা টুডু বলেন, “যাদের বেশি ছোট বাচ্চা আছে তারা
হয়তো আশাপাশে কার ঘরের বারান্দায় রাতে থাকে। এছাড়া সবাই এভাবে গাছতলাতেই
থাকি”।
কবিতা টুডু
বলেন, পুলিশ এসে কাল টহল দিয়ে গেছে। আমাদের কোন অসুবিধা আছে কিনা দেখতে
এসেছিল। কিন্তু আমরা বললাম আপনারাই তো আমাদের উপর গুলি করেছেন, এখন আপনাদের
উপর ভরসা করি কিভাবে?
কবিতা টুডু
জানান, শিশুরা এখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি। পুলিশ কিংবা প্রশাসনের
কাউকে দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যায় তারা। পাড়া থেকে বের হবার সাহসও পাচ্ছেন না
তারা। তাই কোন কাজ করা কিংবা কিছু কিনে আনাও সম্ভব হচ্ছে না। যারা ত্রাণ
দিয়ে যাচ্ছেন সেটাই সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাচ্ছেন। একবেলা খাবার জুটছে তো
আরেক বেলায় জুটছে না।
গত ৬
নভেম্বরের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বিমল কিসকো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে
যাওয়ার পর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়
গাইবান্ধা কারাগারে। এর মধ্যে আর মিলেনি কোন চিকিৎসা কিংবা সেবা শুশ্রুষা।
গত ১৮ নভেম্বর শুক্রবার অবশেষে তাকে সেখান থেকে মুক্তি দেয়া হলে তাকে বাড়ি
নিয়ে আসা হয়।
বিমল কিসকোর
স্ত্রী চিচিলিয়া বাসকি জানান, এতোদিন ধরে তার কোন চিকিৎসাই হয়নি। গুলির
ব্যথায় মাঝেমাঝে কুঁকড়ে উঠেন তিনি। তখন তার পা হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি।
যতক্ষণ ব্যথা না কমে হাত দিয়ে ধরে বসে থাকতে হয়। ভালো করে কিছু খেতেও পারেন
না এই ব্যথার যন্ত্রণায়।
“আমাদের এভাবে
বাড়িঘর জ্বালিয়ে বের করে দিলো, গুলি করলো। আমরা কোথায় যাবো? আমাদের পাশে
কেউ থাকবে না? এর বিচার হবে না?” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন চিচিলিয়া বাসকি।
এসময় তার কান্নায় আশেপাশে অনেকেই অশ্রুসজল হয়ে উঠেন।
ছররা
গুলিবিদ্ধ আরেকজন চরণ সরেন। মধ্যবয়সী চরণ সরেনও ডান পা জুড়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন
অসংখ্য ছররা গুলির যন্ত্রণা। কোন চিকিৎসা তো দূরে থাক, এমন অবস্থায় ন্যূনতম
ভালো খাবার কিংবা বিশ্রামের জায়গাও নেই তাদের।
মাদারপুর
গ্রাম থেকে জয়পুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও খোলা আকাশের নিচেই দিনযাপন
করছে শত শত পরিবার। তার মধ্যে স্থানীয় অনেকে যেমন আছে তেমনি অধিকৃত জমি
ফিরিয়ে দেয়া হবে তার আদি বাসিন্দাদের এমন প্রতিশ্রুতিতে এখানে ফিরে
এসেছিলেন এমনও অনেকে রয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, ৪/৫ জাতির মানুষ মিলেমিশে
রয়েছে এখানে। যা ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়েই সবাই মিলে পেট চালাচ্ছেন।
চিনিকলের জমি
ফিরিয়ে দেয়া হবে এমন খবরে এখানে ফিরে এসেছিলেন এমন একজন বলেন, “সরকারের কোন
ত্রাণ আমরা নিচ্ছি না। অন্যান্য এনজিও বা মানুষজন যেসব ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছে
সেটা দিয়েই আমরা মিলেমিশে চলছি। সবার তো পেট ভরা সম্ভব না। তাই যা ত্রাণ
আসছে সবাই সমানভাবে ভাগ করে নিচ্ছি”।
জয়পুর গ্রামে
দেখা হয় মুংলি সরেন নামে এক বৃদ্ধার সাথে। একাই থাকেন তিনি। রংপুর চিনিকলের
সেই জমিতে ঘর বানিয়ে একা থাকতেন। জমিতে ধান কাটার কাজ করে দিন যেতো তার।
যখন আক্রমন হয় তখন ভাত খাচ্ছিলেন তিনি। সবাই পালাতে বললেও তিনি বলেছিলেন
পালিয়ে গেলে তো আর ভাত কয়টা খাওয়া হবে না, আমি খেয়ে তারপর যাবো। কিন্তু তার
ভাত খাওয়া শেষ হবার আগেই তার ঘরে আক্রমন হয়। ছররা গুলিতে ক্ষতবিক্ষত তার
বাম পা। একাকী বৃদ্ধা মুংলি সরেন এখন ঠিকমতো হাঁটতেও পারেন না। জীবনের
সায়াহ্নে এসে ভিটেমাটি, কাজ সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে পায়ের যন্ত্রণায়
কাতর হয়ে পড়ে থাকেন তিনি। কেউ রান্না করে কিছু খেতে দিলে খান, নয়তো না
খেয়েই থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করে মুংলি সরেন বলেন, “তখনো অত্যাচার হইছে, কিন্তু আমার জীবনে এরকম অত্যাচার আর দেখি নাই”।
জয়পুর গ্রামের
স্থানীয় বাসিন্দা রত্না বলেন, সেদিন (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গুলি করতে করতে
আমাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। লাথি মেরে মেরে একেকজনকে বের করে
দিয়েছে ওখান থেকে। কতজন যে মারা গিয়েছে কেউ জানে না। অনেক লাশ অ্যাকসিডেন্ট
এর কথা বলে এদিক সেদিক ফেলে দিয়েছে। আমরা খুঁজেও পাইনি। এখনো অনেকে
নিখোঁজ।
রত্না বলেন,
আমাদের পৈতৃক ভিটা এইটা। আমাদের বাপ দাদারা ছিল। আগুন দিলে দিক, গুলি করুক।
আমরা গাছের পাতা খেয়ে থাকবো, মাটি খেয়ে থাকবো তবু আমাদের জমি আমাদের চাই।
এরপর মাদারপুর
ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ত্রাণ বিতরণের আগে
সাবেক ছাত্রনেতা খান আসাদুজ্জামান মাসুম উচ্ছেদকৃত সাঁওতালদের উদ্দেশ্যে
বলেন, আপনারা ত্রাণ চান নাকি জমি চান? এসময় সবাই একসাথে বলে উঠেন, জমি চাই।
এরপর আদিবাসীদের এই ভূমি উদ্ধার এর লড়াইয়ে সংহতি জানান এই দলের
অন্যান্যরা।
সাঁওতালদের
উদ্দেশ্যে জাকিয়া শিশির বলেন, “আপনারা সংখ্যালঘু না। এই দেশে আমার যেমন
অধিকার, আপনাদেরও তেমন অধিকার। আপনারা তাই নিজেদের দুর্বল ভাববেন না।
আপনাদের এই লড়াইয়ে আমরা পাশে আছি”।
আকরামুল হক
বলেন, “আপনাদের বলার কিছু নাই। আপনারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি ত্রাণ
আপনারা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনাদের সাথে যে অন্যায় হচ্ছে সেই কথা বলার জন্য
আমরা ঢাকায় রাস্তায় দাঁড়াই। আপনাদের এই লড়াইয়ে আমরা সবসময় সাথে থাকবো”।
নাগরিক সংহতির
শরীফুজ্জামান শরীফ বলেন, “আপনারা আপনাদের এই লড়াইয়ে এতটুকু ছাড় দিবেন না।
আজ দেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে, আদিবাসীদের উপর নির্যাতন হচ্ছে
কিন্তু সরকার চুপ করে আছে। আমরাও এর শেষ দেখে ছাড়বো। আপনারা ভয় পাবেন না।
জয় আমাদের হবেই”।
কৃষক সমিতির
নেতা মানবেন্দ্র দেব বলেন, “কথা ছিল এই জমিতে আখ চাষ না হলে এই জমি তার আদি
মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আজ আমরা দেখছি এখানে ধান চাষ হয়, তামাক
চাষ হয়, অথচ সেখানে যাদের ঘর ছিল তাদের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাদের
খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য করছে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনারা একা না,
আমরাও আছি”।
জাগরণীয়ার
সম্পাদক শুভ্রা কর বলেন, “আপনারা এখানে আমাদের অল্প কয়েকজনকে দেখছেন।
কিন্তু এই দেশের অসংখ্য মানুষ এখন আপনাদের কথা জানে। আমরা পত্রিকায় আপনাদের
কথা লিখছি প্রতিদিন। দেশের বেশিরভাগ মানুষ আপনাদের পাশে আছে। বরং যারা
আপনাদের উপর অন্যায় করছে তারা সংখ্যায় কম। তাই আপনারা সাহস হারাবেন না। এই
লড়াইয়ে আমরা জিতবোই”।
এরপর
আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার লড়াইয়ে যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ক্ষেতমজুর
সমিতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য সংগঠনের নেতারাও সংহতি
প্রকাশ করেন। এসময় স্থানীয় সিপিবির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ভূমি হারানো
জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাল-ডাল, বিস্কুট, সুজি, শীতবস্ত্র, কম্বল, পোশাক,
বাসনকোসন ইত্যাদি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এরপর মাদারপুর ও জয়পুর
গ্রামের আদিবাসী ও বাঙালিদের জন্য ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা নগদ
অর্থ স্থানীয় প্রতিনিধি রেজাউল করিম স্যার ও রাফায়েল এর মাধ্যমে বুঝিয়ে
দেয়া হয়।
0 comments:
Post a Comment