[গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর শূন্য ভিটায় কর্তৃপক্ষের ট্রাক্টর। ইনসেটে বাস্তুহারা দুই নারী। ছবি : কালের কণ্ঠ]
লিমন বাসার ও অমিতাভ দাস হিমুন, গোবিন্দগঞ্জ ,১৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০
জমি ফিরে পাওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতালরা। শুরুতে তাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
জমি উদ্ধার করে দেওয়ার কথা বলে তাঁরা অসহায় মানুষগুলোর কাছ থেকে দুই বছরে চাঁদা নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা রাখেননি তাঁরা। গত ৬ নভেম্বর তাঁদের মদদে ও নেতৃত্বেই হামলা হয়েছে সাঁওতালপল্লীতে। লুটপাট হয়েছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছে দুইজন সাঁওতাল। পরে আরেকজন মারা গেছে। জান বাঁচাতে সাঁওতালরা এলাকা ছেড়ে চলে গেলে সেই ভিটেমাটিসহ পুরো এলাকা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ট্রাক্টর চালিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে পোড়া বসতির নিশানাও।
সাঁওতালরা দাবি করছে, তাদের বাপ-দাদার এসব জমি ১৯৬২ সালে চিনিকলের জন্য ইজারা নিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
সাঁওতাল ও বাঙালিদের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ১৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি দেওয়া হয় রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষকে। সাহেবগঞ্জে সেই জমিতে সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রাম ছিল। ইজারার সেই কাগজপত্রও তাদের (সাঁওতাল) কাছে আছে। ইজারা নেওয়া জমিতে আখচাষের জন্য গড়ে তোলা হয় সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার। ওই চুক্তির ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে, ইজারা নেওয়া হলেও কখনো যদি আখচাষের কাজে জমি ব্যবহার করা না হয়, তাহলে এসব জমি চিনিকলের কাছ থেকে সরকারের কাছে ফেরত যাবে। পরবর্তী সময়ে সরকার জমি আগের মালিকের কাছে ফেরত দেবে।
তবে চিনিকল কর্তৃপক্ষের দাবি, ইজারা নয়, এসব জমি সে সময় অধিগ্রহণ করা হয়েছিল।
সাঁওতালরা বলছে, লোকসানের কথা বলে মাঝে ২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধও করে দেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালে এটি আবার চালু করা হয়। অথচ এখন এসব জমিতে মিলের জন্য আখচাষ না করে ধান, তামাক ও শাকসবজি চাষ করা হচ্ছে। কিছু জমি চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষাবাদের জন্য অন্য লোকদের কাছে ইজারাও দিয়েছে। এর মাধ্যমে মিল কর্তৃপক্ষ ইজারার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি আদিবাসী নেতা ফিলিমন বাসকে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চুক্তি ভঙ্গের বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসনে অভিযোগ করেছিলাম। গত বছর এ বিষয়ে তদন্ত করে জেলা প্রশাসনও অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়ে তৎপর হয়নি কর্তৃপক্ষ। ’
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি দেখতে পেয়েছে, চিনিকলের জমিতে আখ চাষ কম হচ্ছে। সেখানে তামাক ও শাকসবজি চাষ হচ্ছে। কমিটির প্রতিবেদন পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এখন জমির প্রকৃত মালিক কে—এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, সেটা কাগজপত্র না দেখে বলা যাবে না।
কেন্দ্রীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন দাবি করেন, শুরু থেকে আদিবাসীদের ব্যবহার করেছেন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর সহযোগীরা। তাঁরা শুরুতে আদিবাসীদের ভূমি উদ্ধার আন্দোলন উসকে দিয়েছেন। আন্দোলনের জন্য তাদের পথে নামতে বাধ্য করেছেন। এসব কর্মকাণ্ডের ভিডিও রেকর্ড তাঁদের হাতে রয়েছে। এখন হামলার পর এমপি ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করছেন।
গত রবিবার সরেজিমনে সাহেবগঞ্জ এলাকা ঘুরে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, ৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জে ইক্ষু খামারের সাঁওতালপল্লীর বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ শুরু থেকেই জানতেন। হামলায় পুলিশের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমপির আস্থাভাজন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল। তিনি এমপির আত্মীয়ও। শাকিলকে সহযোগিতা করেন মহিমাগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ প্রধান। পুলিশের সামনে থেকে তাঁরাই লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন। হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন সাঁওতাল নিখোঁজ রয়েছে। নিহত হয়েছে তিনজন।
সাহেবগঞ্জ এলাকার সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামে সেদিন পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। সাঁওতালরা বলছে, লুটপাট ও হতাহতের ঘটনার পর এক সপ্তাহ পার হলেও পুলিশ তাদের কোনো অভিযোগ নেয়নি। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের ভয়ে বসতিছাড়া হয়েছে শতাধিক পরিবারের পুরুষ সদস্য।
ফিলিমন বাসকে অভিযোগ করেন, ৬ নভেম্বর বিকেলে কথিত পুলিশি অভিযানের প্রস্তুতির সময় এমপি আবুল কালাম আজাদ উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নে ইক্ষু খামারের সামনে কাটামোড়ে অবস্থান করছিলেন। অভিযান শুরুর আগ মুহূর্তে তিনিও তাতে অংশ নেন। এরপর ইক্ষু ক্ষেতের ভেতর থেকে হ্যান্ডমাইকে তিনিই শাকিল চেয়ারম্যানকে হামলার নির্দেশ দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জমি উদ্ধারের দাবিতে সাঁওতালদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল সে সময় ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সাঁওতালদের পক্ষে এমপি আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে গঠন করা হয় ‘সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষুু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি। সে দিন কাটামোড়ে আয়োজিত সমাবেশে এমপির সঙ্গে ছিলেন শাকিল। সেখানে সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাসকেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি (ফিলিমন) জানান, এমপির নির্দেশেই শাকিলকে কমিটির সভাপতি করা হয়।
সাঁওতালরা জানায়, শাকিল সভাপতি হওয়ার পর গত আড়াই বছরে জমি উদ্ধারের নামে সাঁওতালদের কাছ থেকে ৫০ লাখেরও বেশি টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করেছেন। তাঁর নির্দেশেই প্রায় সাড়ে চার মাস আগে চিনিকলের সেই জমিতে সাঁওতালরা বসতি স্থাপন করে। বিভিন্ন সময় চলমান আন্দোলন ও বসতি স্থাপনের পর সব বিষয়ে জানতেন এমপি। ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির ব্যানারে আন্দোলনে নেমে সাঁওতালরা মাদারপুর গ্রামের ওই জমিতে বসতি গড়েছিল। এর আগে দুই বছর ধরে তাদের আন্দোলন, মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান কার্যক্রম চলে শাকিলের নেতৃত্বে। কমিটির সভাপতি হওয়ায় সাঁওতালদের কাছে শাকিলের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। এ বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাঁওতালদের ভোটে সাপমারা ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পরই ভোল পাল্টে যায় তাঁর।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, এক সপ্তাহ আগেও যেখানে ছিল সাঁওতালদের কয়েক হাজার পরিবারের ঘর, এখন সেটি বিরানভূমি। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের পাহারায় চিনিকল কর্তৃপক্ষের চারটি ট্রাক্টর সেই জমিতে চাষ দিচ্ছে। জমি ঘিরে দেওয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। ইতিমধ্যে সাঁওতালপল্লী এলাকার চারপাশে কয়েক হাজার খুঁটি পোঁতার কাজ শেষ করে তাতে তারকাঁটা লাগানো হয়েছে। বাকি অংশেও কাজ চলছে। আর উচ্ছেদ করা জমিটি চাষের জমি দেখাতে সেখানে ফসল লাগানোর প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে।
সাঁওতালরা বলেছে, বাপ-দাদার এসব জমিতে মিলের জন্য আখ চাষ না করে কয়েক বছর আগে ধান ও তামাক চাষ করায় তারা জমি ফেরতের দাবি তোলে। এরপর এমপি ও শাকিল চেয়ারম্যানের নির্দেশেই সেখানে ঘর তুলেছিল। তারাই আবার তাদের ঘরছাড়া করেছে। এখন দিন কাটছে অনাহারে, খোলা আকাশের নিচে। গ্রেপ্তার এড়াতে এলাকাছাড়া হয়েছে সাঁওতাল পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। নারী ও শিশুরা কার্যত অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছে। খামারের পাশে একটি খোলা মাঠে পাশাপাশি শতাধিক চুলা খুঁড়ে কোনো রকমে রান্না করে দিন পার করছে তারা।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভূমি দখলের ফাঁদে ফেলে হেনস্তা করা হচ্ছে সাঁওতালদের। হামলার ব্যাপারে মুখ না খুলতে গতকাল সোমবারও দিনভর স্থানীয় কাটাবাড়ি এলাকায় মাইকিং করে সাঁওতালদের হুমকি দেওয়া হয়। অন্য গ্রাম থেকে সাঁওতালদের ভাড়া করে এনে তাদের দিয়ে সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রচার করা হয়।
মাদারপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত তরুণ মুরমু, মিকাই মুরমু, রুমিলা কিসকু বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। কৃষিকাজ করে সংসার চলে। শাকিল চেয়ারম্যানের ইন্ধনে বাপ-দাদার জমি ফেরত পাওয়ার আশায় ধারদেনা করে মিলের জমিতে চালাঘর তুলেছিলাম। দুই বছর ধরে শাকিল ও তাঁর লোকজন আমাদের কয়েক হাজার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে রসিদ দিয়ে ৫০ টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন। বলেছিলেন, জমি উদ্ধারে এ টাকা খরচ হচ্ছে। যারা টাকা দিতে পারেনি তাদের কাছে থেকে চাল, গুড় ও ভুট্টা নেওয়া হতো। কিন্তু এখন ভোটে জিতে বদলে গেছেন শাকিল। তাঁর নেতৃত্বেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতেই ঘরগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হামলাকারীরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বাড়ির যাবতীয় মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এখনো ভয়ে আছি, না জানি কখন আবার হামলা হয়। ’
ঘটনাস্থল ঘুরে এসে ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, আদিবাসী-বাঙালির সম্মিলিত ভূমির অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর ৬ নভেম্বর পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তান বাহিনী হামলা চালায়। বিনা উসকানিতে সাধারণ নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করে তারা পাঁচ আদিবাসীকে গুরুতর আহত করে। তাঁদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নিখোঁজ হন আরো ১৬ জন।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাসকে জানান, সাঁওতালপল্লীর মানুষ চরম দুর্দশার মুখে পড়েছে। হুমকি ও লাঞ্ছনার আতঙ্ক কাটেনি। ভয়ে-আতঙ্কে তাদের ছেলেমেয়েরা এখনো স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। সাঁওতালরা গ্রামের বাইরে গেলেই লাঞ্ছিত হচ্ছে। স্থানীয় দুর্বৃত্তরা টাকাসহ মালামাল কেড়ে নিচ্ছে, মারধর করছে। পাশের কাটাবাড়ী ইউনিয়নের লোকজন উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের হাট-বাজার করতে দিচ্ছে না। তবে যত জুলুম, নির্যাতন করা হোক ওই জমির মালিকানার দাবিতে যৌক্তিক আন্দোলন ও আইনি লড়াই তারা চালিয়ে যাবে।
তবে হামলায় ইন্ধন ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ। তাঁর ভাষ্য মতে, সেদিন (৬ নভেম্বর) তিনি টাঙ্গাইলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন। ঘটনার পরদিন এলাকায় যান এবং ৮ নভেম্বর মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতালপল্লীর ৫০টি পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
আর চেয়ারম্যান হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করলেও হামলা ও অগ্নিসংযোগে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করেছেন শাকিল চেয়ারম্যান। তাঁর ভাষ্য মতে, দুই বছর আগে ‘ভুল’ তথ্য পেয়ে সাঁওতালদের আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। ‘ভুল’ ভাঙলে গত জানুয়ারিতে সংহতি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।
সেদিনের সংঘর্ষের বিষয়ে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়াল বলেন, বীজ হিসেবে সংগ্রহের জন্য চিনিকলের রোপণ করা আখ কাটতে গেলে সাঁওতালরা বাধা দেয়। এরপর মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ বাধে। তিনি দাবি করেন, একপর্যায়ে সাঁওতালরা পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের উদ্দেশে তীর ছোড়ে। এতে ৯ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন তীরবিদ্ধ হয়। এতে স্থানীয় জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে সাঁওতালদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে ইউপি চেয়ারম্যান শাকিলও ছিলেন।
গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, সংঘর্ষে ৯ পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন তীরবিদ্ধ হলে পুলিশ ওই এলাকায় আসামি গ্রেপ্তার করতে যায়। এর ফাঁকে কোনো এক সময় স্থানীয় গ্রামবাসী সাঁওতালদের ঘরগুলোতে আগুন দেয়। পুলিশ কোনো উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেয়নি। আর সেদিন পাঁচ ম্যাজিস্ট্রেটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের নির্দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি চালায়।
স্থানীয়রা বলছে, ঘটনার পর ৪২ জন সাঁওতালের নাম উল্লেখসহ আরো সাড়ে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। মামলার পর থেকে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় হামলা চালাচ্ছে ইক্ষু খামারের আশপাশের গ্রাম কলুপাড়া, ফকিরগঞ্জ, মেরী, রহিমাপুর, পানাতেপাড়া ও গোয়ালপাড়ায়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পর এসব গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে সাওতালরা। অথচ সাঁওতালদের প্রাণহানি কিংবা নিখোঁজের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।
গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আদিবাসীরা মামলা করতে এলে সেটি গ্রহণ করা হবে। আর পুলিশ মামলা না নিলেও আদালতে মামলা করার সুযোগ রয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, সেদিন উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিকেলে পুলিশ ওই এলাকায় আসামি গ্রেপ্তারের অভিযান চালায়। ওই সময় পাশের সাত-আট গ্রামের লোক দখলদারদের একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়। তিনি তখন ওই এলাকায় কর্তব্যরত ছিলেন মাত্র। উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেননি।
ইউএনও বলেন, ইক্ষুু খামারের ১৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমির মধ্যে আখ চাষের পর অনেক জমি পরিত্যক্ত থাকে। পরিত্যক্ত ওই জমিতে স্থানীয় গ্রামবাসী গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়ায়। আবার কেউ কেউ ওই ঘাস কেটে বিক্রি করে। কিন্তু সাঁওতালরা দখল করার পর গ্রামবাসীকে ওই পরিত্যক্ত জমিতে আসতে দিত না। সেই ক্ষোভ থেকে তারা এ কাজ করেছে।
হাতকড়া খুলে দেওয়ার নির্দেশ হাইকোর্টের : ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গোবিন্দগঞ্জে হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন সাঁওতালের হাতকড়া খুলে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের হাতকড়া পরানো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ নির্দেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার করা রিট আবেদনে এ আদেশ দেন আদালত।
হাইকোর্টের আদেশ প্রতিপালনের বিষয়ে ঢাকা পুলিশ কমিশনার, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি ও গাইবান্ধার পুলিশ সুপারকে আগামীকাল বুধবারের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, রংপুরের ডিআইজি (পুলিশ), গাইবান্ধার পুলিশ সুপারসহ পাঁচজনকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, হাইকোর্টের নির্দেশ পাওয়ার পর গতকালই ওই তিন সাঁওতালের হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা তিনজন হলেন চরণ সরেন, বিমল বিসকো ও দ্বিজেন টুডু। পুলিশি পাহারায় চরণ সরেন ও বিমল বিসকো রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং দ্বিজেন টুডুকে ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা দেখছেন শিল্পসচিব : বিডিনিউজ জানায়, গোবিন্দগঞ্জে ভূমিবিরোধের জের ধরে চিনিকলকর্মীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষের সময় হতাহতের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়ী নয় বলে দাবি করেছেন শিল্পসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সংঘর্ষ ‘মিটে গেলেও’ আন্দোলনকারীরা পরিস্থিতি ‘অস্বাভাবিক করে রেখেছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, এর পেছনে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ‘প্ররোচনা’ রয়েছে।
গতকাল শিল্প মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্রিফিংয়ে শিল্পসচিব বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও র্যাব যে কাজটি করেছে, সেটি হলো—টিয়ার শেল, ফাঁকা গুলি এবং শটগানের গুলি, যে গুলিতে লোকক্ষয়ের কোনো সম্ভাবনা নাই। যে দুজন মারা গিয়েছে, যখন অপারেশন হয় সেই পর্যায়ে, একজন খাট থেকে পড়ে, আরেকজন কোথায় যেন...পরে পল্লীতে মারা গেছে, সেটা তো খবরের কাগজেও আমরা দেখেছি। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এটা নিয়ে আমাদের কোনো কথা নাই, কেউ বলে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, কেউ কেউ বলে সে আগে আহত হয়েছিল। ’ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরই তাদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন শিল্পসচিব।
শিল্পসচিব বলেন, ‘আমরা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে অবৈধ দখলদারমুক্ত করেছি। আপনারা লক্ষ করবেন, অবৈধ দখলটি মুক্ত করার জন্য আমরা যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির চিন্তাভাবনা করেছিলাম, হয়তো উভয় পক্ষের অনেক ক্ষতি হবে, আমার মনে হয় আল্লাহর রহমতে সেই পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এটি একটি ভালো দিক।
0 comments:
Post a Comment