তারিকুল ইসলাম
মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ না থাকায় দেশেই বিপন্ন হচ্ছে অনেক ভাষা। এরই মধ্যে ওঁরাওদের 'কুরুখ' ও বর্মণদের 'নাগরি' ভাষা বিপন্ন হয়ে গেছে। কোচ ও রাজবংশীদের ভাষাও প্রায় বিপন্নের পথে।ইউনেসকোর ইথোনোলগের এক জরিপে দেখা যায়, রাজশাহীর পুঠিয়ার কোডা, নেত্রকোনা কলমাকান্দার মিগাম, রাঙ্গামাটির মাঙ্খুয়া ও রিয়াং এবং সাক ভাষাও বিপন্নের পথে। ইথোনোলগ এসব ভাষাগুলোকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন চাক, চাইন, খাশি, এমরু, পিনার, সাউরিয়া পাহারিয়া, ইউসোই ও ওয়ার-জাইনটিয়া ভাষাকে। এ ভাষাগুলো বর্তমানে খুব কমসংখ্যক মানুষ ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও প্রায় ৪৫টি নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী আছে। ভাষা আছে প্রায় ৪২টির মতো। আদিবাসী অধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, সরকার উদ্যোগ না নিলে অনেক জনগোষ্ঠীর ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে। যে দেশে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, সে দেশে এমন ঘটনা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে।
আদিবাসীবিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশনের মুখপাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই দায়িত্ব পালন করবে বলে কখনো কখনো বলা হয়; কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কোনো কর্মপরিকল্পনা করেনি। তবে আদিবাসীদের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ আছে।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, একটি দেশে কতগুলো ভাষা আছে এবং এদের পরিচয়ের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য ভাষাতাত্তি্বক সমীক্ষা করতে হবে, যেটা এখন পর্যন্ত হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো_ বিশ্বের সব মাতৃভাষা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিপন্ন ভাষাগুলোকে রক্ষা করা। এ সম্পর্কিত একটি 'আর্কাইভ' করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেখানে এসব সংরক্ষিত থাকবে।
ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নেই : ১৯৯১ সালের আদম শুমারি প্রতিবেদনে দেশে ২৯টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তথ্য উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে। আর ইথোনোলগ ল্যাঙ্গুয়েজ অব ওয়াল্ডের মতে, এসব জনগোষ্ঠীর ভাষা আছে প্রায় ৪২টি।
গবেষক রাজীব চাকমা বলেন, আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণের কাজটি সরকার সহজেই করতে পারে। কারণ অনেক ভাষায় লিখিত রচনা আছে। ২০০৫ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় চাকমা ভাষার উপন্যাস বেরিয়েছে। মণিপুরিদের ভাষা 'মৈথয়ী'র ইতিহাস শতবর্ষের পুরনো। সাঁওতালি ভাষায় সাহিত্যচর্চার ইতিহাস ১৪০ বছরের। সাঁওতালি ভাষায় সাহিত্য ও অভিধান রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অসংখ্য সাঁওতালি বিদ্যালয় রয়েছে। ঝাড়খ-ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা হয় এই ভাষায়। বান্দরবানে ২০০৯ সালে জিরকুন সাহু নামে একজন 'বম' ভাষায় অভিধান করেছেন। ভারতে হাজং থেকে ইংরেজি, সাঁওতাল থেকে ইংরেজি, খাসিয়া থেকে ইংরেজি ভাষায় অভিধান আছে।
ভারতের ত্রিপুরায় ত্রিপুরী (ককবরক) ভাষায় মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা রয়েছে। মিজোরাম ও ত্রিপুরায়ও গারোদের আচিক ভাষায়, মিয়ানমারে মারমা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে; কিন্তু '৪৭ সালের আগে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমাদের বিদ্যালয় থাকলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকার সেগুলো বন্ধ করে দেয়।
মাতৃভাষায় শিক্ষা উপেক্ষিত : জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিজ ভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকারী। এই সনদে বাংলাদেশও সই করেছে। এ সংক্রান্ত আইন সংসদেও পাস হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ২০০৪ সালে 'আদিবাসীদের শিক্ষা ও ভাষার চাহিদা' বিষয়ে অধ্যাপক মেসবাহ কামালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৯৪ শতাংশ আদিবাসী শিশু বাড়িতে নিজ ভাষায় কথা বলে। এরা বিদ্যালয়ে গিয়ে বাংলা ভাষা বুঝতে পারে না। মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় তারা ঝরে যায়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নেতা বাহাদুর চাকমা বলেন, চাকমা, মারমা, রাখাইন, ম্রো, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, বম, গারো, খাসিয়া, হাজং, মণিপুরি, ওঁরাও, মুন্ডা, তঞ্চঙ্গ্যাসহ অন্তত ১৫টি ভাষায় এখনই শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। কারণ এসব ভাষাভাষির সংখ্যা অনেক এবং এসব ভাষায় লিখিত রচনা পাওয়া যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশকিছু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ব্যবহার করে শিক্ষাদান করছে কিছু বেসরকারি সংগঠন। ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস ২০০৮ সালে মৌলভীবাজারে খাসিয়াদের জন্য আটটি মাতৃভাষায় শিক্ষাদান স্কুল চালু করে। অবশ্য তহবিল-সংকটে পাঁচটি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এই স্কুলগুলোতে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। সিলেটে এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এডকো) ২০১০ সালে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানোর জন্য বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে মণিপুরি ভাষায় একটি বই করেছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ১৯৯৯ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সাঁওতাল শিশুদের জন্য দুটি স্কুল করেছে। তারা সাঁওতাল ভাষায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কয়েকটি বই করেছেন। রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জে 'আশ্রয়' নামে একটি সংগঠন ওঁরাও ভাষায় দুটি স্কুল করেছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর শিশুরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে পারে সরকার সে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিছু ভাষায় পাঠ্যপুস্তকও ইতিমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।
Source: http://www.dainikdestiny.com/index.php?view=details&type=main&cat_id=1&menu_id=1&pub_no=80&news_type_id=1&index=0&archiev=yes&arch_date=21-02-2012
*****************************************************************************
0 comments:
Post a Comment