গাইবান্ধা প্রতিনিধি জাতীয়
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, গাইবান্ধার
গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি থেকে সাঁওতালদের
উচ্ছেদ আইনি প্রক্রিয়ায় হয়নি।
বিরোধপূর্ণ ওই জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পাঁচ সপ্তাহ পর সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে এ কথা বলেন তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অপর সদস্যরা ছাড়াও আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস
কমিটি ও ইউএনডিপির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে ছিলেন।
রিয়াজুল হক বলেন, 'সাঁওতালরা বৈধ বা অবৈধ যেভাবেই চিনিকলের খামারের জমিতে
বসতি গড়ে তুলুক না কেন, তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় উচ্ছেদ করা হয়নি। আদালতের
নির্দেশনা অনুযায়ী এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হতো।'
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, জোর করে কাউকে কোনো এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি।
'সাঁওতাল পল্লীর উচ্ছেদ ঘটনায় মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। উচ্ছেদের
সময় ঘরবাড়িতে আগুন ও হত্যাসহ অনেক অন্যায় আমাদের চোখে প্রাথমিকভাবে ধরা
পড়েছে।'
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের এক হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে
অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার
গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের
চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।
এরপর সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই
জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল
কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের
বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত
হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর গুলিবর্ষণের ওই ঘটনায় সমালোচনা হয় দেশজুড়ে। ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হয়।
অন?্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একটি 'স্বার্থান্বেষী মহল' জমি
উদ্ধার করে দেয়ার কথা বলে সাঁওতালদের সংগঠিত করে চিনিকলের জমিতে অস্থায়ী
স্থাপনা তৈরি করিয়েছিল। ওই জমি অবৈধ দখলমুক্ত করতেই উচ্ছেদ অভিযান চালাতে
হয়েছে।
উচ্ছেদের পর মাদারপুর গ্রামের গির্জার সামনে যে মাঠে অনেক সাঁওতাল আশ্রয়
নিয়েছেন, সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে রিয়াজুল হক বলেন, সংবিধান অনুযায়ী
এদেশে সাঁওতাল, গারো, চাকমা, হিন্দু, মুসলিম সবার সমান অধিকার। কিন্তু
সাঁওতাল পল্লীতে সরকারি উদ্যোগ 'যথেষ্ট হয়নি'।
'চিনিকল বন্ধ কিংবা অন্য কোনো কারণে মিলের জমি যদি লিজ দিতে হয়, তবে তা
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাঁওতালদের দিতে পারত। কিন্তু কোনোভাবেই প্রভাবশালীদের
দেয়া ঠিক হয়নি।'
উচ্ছেদের পর ওই জমি দ্রুত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলারও সমালোচনা করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম?্যান।
তিনি বলেন, 'কাঁটাতারের বেড়া মানুষের শক্তির কাছে তুচ্ছ। তারা কি
কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিজেদের নিরাপদে রাখতে চাচ্ছে? নাকি অন্য কিছু বোঝাতে
চাচ্ছে?
চেয়ারম্যান জানান, পরিদর্শক দলের সদস্যরা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও কথা বলেছেন।
'আমরা এখানে এসেছি প্রকৃত ঘটনা জানতে। এ ঘটনায় যেই জড়িত থাকুন না কেন,
তাকে শাস্তি দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছি, কোনো নিরপরাধ
ব্যক্তিকে আটক করে যেন হয়রানি না করা হয়।'
আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস কমিটির আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন,
'নিরাপত্তার জন্য এখনো সাঁওতালদের তীর-ধনুক নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। এটা
রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার।'
তদন্ত দলের সদস্যরা রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ, সাঁওতাল ও বাঙালিদের সঙ্গেও কথা বলেন।
রিয়াজুল হক সাংবাদিকদের বলেন, 'সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম।'
প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে আরও যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন আছে জানিয়ে তিনি বলেন,
'তদন্তের স্বার্থে এখনই সব বলা যাচ্ছে না। তবে উচ্ছেদ ঘটনায় নির্যাতনের
স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।'
আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাস কমিটির সদস্য এ কে ফজলুল হক, টিপু সুলতান, ককাসের
টেকনোক্র্যাট সদস্য অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের
পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) শরিফ উদ্দিন, ইউএনডিপির চিফ টেকনিক্যাল
অ্যাডভাইজর (হিউম্যান রাইটস) শর্মিলা রাসুল, প্রোগাম কো-অর্ডিনেটর তাসলিমা
নাসরিন ও কমিউনিটি অ্যান্ড মাইনোরিটি এক্সপার্ট শংকর পাল এই পরিদর্শক দলে
ছিলেন।
পরিদর্শক দল মাদারপুর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সাঁওতালরা তীর-ধনুক ও লাঠি নিয়ে
বিক্ষোভ দেখায়। তারা সাঁওতালদের ওপর 'হামলাকারী ও হত্যাকারীদের' দ্রুত
বিচার ও জমি ফেরতের দাবি জানিয়ে সস্নোগান দেয়। বিক্ষোভ মিছিলটি মাদারপুর
সাঁওতাল পল্লী প্রদক্ষিণ করে।
সংঘর্ষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই কল্যাণ চক্রবর্তী ৩৮ জনের নাম উল্লেখ
করে সাড়ে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার
করার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
অন?্যদিকে হামলা, অগি্নসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদের ঘটনায় গত ১৬ নভেম্বর স্বপন
মুরমু নামে একজন অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলায় মোট
২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা এখন কারাগারে।
এরপর গত ২৬ নভেম্বর সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত থোমাস হেমরম বাদী হয়ে ৩৩
জনের নাম উল্লেখ করে ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি এজাহার দাখিল করেন, যা
এখনো তদন্তাধীন আছে বলে পুলিশের ভাষ?্য।http://www.jaijaidinbd.com/?view=details&type=single&pub_no=1750&cat_id=1&menu_id=14&news_type_id=1&news_id=268719&archiev=yes&arch_date=13-12-2016
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment