Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠির জীবন চিত্র

কৃষি নির্ভর নওগাঁ জেলার কৃষিকাজের মূল শক্তি নওগাঁর আদিবাসী জন গোষ্ঠি। এই আদিবাসীরাই নওগাঁর সিংহভাগ কৃষিকাজ করে থাকে। নওগাঁ জেলার আদিবাসীরা জেলার উন্নয়ন, সমাজ ও সাংস্কৃতির এক বিরাট অংশ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সমাজের নিস্পেষন আর বঞ্চনার স্বীকার হয়ে আদিবাসীরা আজ নিজেদের অস্থিত্ব নিয়ে হুমকির সম্মূখিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের কিছু লেখক উপজাতি আর আদিবাসীদের এক করে ফেলেছেন। কিন্তু সংগাগত ভাবেই আদিবাসী আর উপজাতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আদিবাসীদের ইংরেজীতে বলা হয় Aborigines আর উপজাতিদের বলা হয় Tribe। Encyclopedia থেকে এ দুটি প্রতিশব্দ অনুসারে পাওয়া যায় Aborigines হলো In modern times the term ''Aborigines" has been extended in signification, and is used to indicate the inhabitants found in a country at its first discovery, in contradistinction to colonies or new races, the time of whose introduction into the country is known আর Tribe হলো Its ethnological meaning has come to be any aggregate of families or small communities which are groped together under one chief or leader, observing similar customs and social rules, and tracing their descent from one ancestor. এ থেকে আদিবাসী আর উপজাতি যে এক নয় তা না বোঝার কোন কথা নয়।

নওগাঁর আদিবাসীদের বসবাসের ইতিহাস অনেক দিনের। ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে নওগাঁয় পুন্ড্রা আদিবাসী দের অস্থিত্ব পাওয়া যায়। এর পর পাওয়া যায় শরবদের অস্থিত্ব। কিন্তু বর্তমানে এ দুটি আদিবাসীদের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায় না। এই দুই আদিবাসীদের পর পাওয়া যায় নওগাঁর বৃহত্তর আদিবাসী গোষ্ঠি সাঁওতাল জনগোষ্ঠির অস্থিত্ব। গবেষক লেখক অধ্যাপক আতাউল হক সিদ্দিকির গবেষনা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পর এরা নওগাঁ ছেড়ে নওগাঁর পার্শ্ববর্তি মালদহ, বামনগোলা ও হিলি অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। পরে কোন এক সময়ে (সম্ভবত ১৮৭০ সালে) জোতদারদের প্রয়োজনে তাদেরই আমন্ত্রনে ধীরে ধীরে এরা নওগাঁর শালবন অধ্যুষিত এলাকা ধামুরহাটের বিভিন্ন বনাঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। এ সময় এই বনাঞ্চলে সামান্য চাষাবাস ও বিভিন্ন পশুপাখি শিকার করে এরা জীবন ও জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি জোতদারদের জমাজমি চাষ করতো। কোন কোন লেখকের বর্ণনা মতে এই সাঁওতাল জন গোষ্ঠিই নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চলের আদি জন গোষ্ঠি। কিন'ু কি ভাবে এরা এই বিশাল বরেন্দ্র অঞ্চলের জমির মালিক না হয়ে ভূমিহীন শোষিত শ্রেনীতে পরিণত হলো তা আজ ও রহস্যাবৃত্য রয়ে গেছে।

নওগাঁর সাঁওতাল জনগোষ্ঠি সমাজে নিস্পেষিত হলেও এর মাঝে নিজেদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায় ১৯১৬ সালের আগে কোন এক সময়ে এই সাঁওতালরা এদের বসতি এলাকা নওগাঁর বেণীদুয়ার এলাকায় একটি ৩য় শ্রেনী পর্যন্তু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল যা কালের পরিক্রমায় আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহী আদিবাসীদের কলেজে রুপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে সাঁওতালদের মধ্যে প্রচুর উচ্চ শিক্ষিত মানুষ পাওয়া যায়। নওগাঁর সাঁওতালদের মধ্যে আজ বেশ কজন অধ্যাপকও রয়েছেন। লেখাপড়ায় অগ্রসর হয়ে নওগাঁর সাঁওতালদের মধ্যে অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে এসেছে। জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায় বেশ কটি জোতদার সাঁওতাল পরিবারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সাঁওতালদের নিজস্ব একটি ভাষা ও সাংস্কৃতি রযেছে। হালে এরা বাংলা ভাষার সাথে মিশে যেতে সক্ষম হলেও নিজেদের মধ্যে এখনো অস্ট্রিক ভাষার অন্তগত খেরওয়রি ভাষায় কথাবার্তা বলে থাকে। লিখার ক্ষেত্রে এরা রোমন ভাষার বিভিন্ন বর্ণ ব্যবহার করে থাকে।

নওগাঁ জেলার অধিকাংশ সাঁওতাল ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করলেও সাঁওতালদের নিজস্ব একটি ধর্ম রয়েছে।যার নিদৃষ্ট কোন নাম পাওয়া যায় নি। তবে এ ধর্ম কিছুটা হিন্দু ও কিছুটা বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রন বলে মনে হয়। তাদের মতে তাদের আদি বাসস্থান 'হিহিরি-পিপিরি' যা অনেক ঐতিহাসিকের মতে সম্ভবত ব্যাবিলন। তাদের ধর্ম বিশ্বাষ মতে পৃথিবীর আদি মানব দম্পতি পিচলু হরম ও পিচলু বুড়ির সাত জোড়া সন্তান পৃথিবীতে সাতটি সমপ্রদায়ের সৃষ্টি করে যা হাস্‌ডক বা হাস্‌দা, মুর্ম্মু, কিস্‌কু, হেমব্রম, মার্ডি বা মারানডি, মারন্ডি এবং সোরেন, সরেন সমপ্রদায় হিসাবে পরিচিত। পরে এই সাত সমপ্রদায় আরো পাঁচটি সমপ্রদায় সৃষ্টি করে। এ সমস্ত হলো বাস্‌কে, বেসরা, পাউরিয়া, চোরে এবং বেদিয়া। এদের প্রধান আরধ্য দেবতা হলো সিংবাঙ্গো বা সূর্য। ধর্ম উৎসবে এরা নাচগান আর হাড়িয়া পান করে। কোন কোন ধর্ম উৎসব সাত দিন ধরে চলে। ধর্ম উৎসবে সাঁওতালরা দেবতার উদ্দেশ্যে সাদা মোরগ বা পাঁঠা বলি দিয়ে থাকে। কোন কোন উৎসবে এরা জোড়া পায়ড়াও বলি দিয়ে থাকে। পুঁজা পার্বণে এরা হাড়িয়া পানের পাশে পাশে শুকুরের মাংশ সহযোগে উৎসব করে থাকে। একই সাথে পুঁজা পার্বণে এরা মহুয়া ফুল ও ফলের রস দিয়ে প্রস'তকৃত এক ধরণের বিশেষ পানিয় পান করে থাকে। তবে প্রতিটি পুঁজা পার্বণে এদের শালগাছ ও ফুল অপরিহার্য। শাল গাছের অভাবে এখন তারা অনেক সময়ে বট বা আম গাছও ব্যবহার করে থাকে। এদের ধর্মীয় উৎসব গুলির মধ্যে মারাং বুরুর পুঁজা, বোঙ্গাপুঁজা, পুষণা, ফাগুয়া ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া বা:সরিক উৎসব হিসাবে সাঁওতাল জনগোষ্ঠি কারাম উৎসব নামে একটি উৎসব পালন করে থাকে। শিকার করা সাঁওতালদের একটা ধর্মীয় অংশ। এ কারণে বছরে অন-ত এক দিন সাঁওতাল পুরুষদের তীর ধনুক নিয়ে শিকারে বের হয়ে কুকুর, বিড়াল, উদ, ইদুর, খটাশ বা খোরগোস কোন কিছু একটা শিকার করতেই হবে।

সাঁওতালরা জাতি হিসাবে খুব পরিচ্ছন্ন এবং সমাজবদ্ধ। এদের সমাজে একজন করে দলপতি থাকে তার তার থাকে কযেকজন সহযোগি। দলপতিদের এরা মাঝি বলে সম্বোধন করে থাকে। এই মাঝিরাই এদের বিচার-বিবাদ মিমাংশা ইত্যাদি করে থাকে। নিজেদের কোন বিবাদ বিসম্বাদ নিয়ে এরা কখনো আইন আদালতের ধারে কাছেও যায় না। মাঝিদের বিচার ব্যবস্থাই এদের কাছে দেবতার নির্দেশ।

সাঁওতালদের আগে আট দশ প্রকার বিবাহ রীতির প্রচলন থাকলেও আজকাল 'ইদ্যুৎ' আর 'রায়বাড়' নমের বেশ চমকপ্রদ দু ধরণের বিবাহ রীতির প্রচলন রয়েছে। 'ইদ্যুৎ' প্রথা অনুসারে কোন সাঁওতাল যুবক তার পছন্দের সাঁওতাল যুবতীকে সিদুর পড়িয়ে দিতে পারলেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ওই যুবতীর পছন্দ-অপছন্দ এবং সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি সবই উপেক্ষিত। এ প্রথাটি তাদের মধ্যে খুব একটা জনপ্রিয় নয়। নেহাতই ধর্মীয় ভাবে স্বীকৃত বলে আজও তারা এ প্রথাটি মেনে চলে। তাদের মধ্যে 'রায়বাড়' প্রথাটি বেশ জনপ্রিয়। 'রায়বাড়' প্রথা অনুসারে বর কনের বাড়ীতে 'রায়বার' বা ঘটক পাঠিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এর পর 'লসমিদা' বা পাকাদেখার পর 'সুনুস-সাসান' বা তেল-হলুদের একটি অনুষ্ঠান হয়। এর পর ঘটক 'লমতা' বা বাজনাদার নিয়ে কনের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে কনের গ্রামের কাছে গিয়ে কোন একটি গাছ তলায় বাজনা বাজাতে থাকে। এ বাজনার শব্দ শুনে কনে পক্ষের লোকজন পাড়ার প্রবেশ মুখে এসে হাজির হয়। এসময় দুপক্ষের মধ্যে একটি লড়াই বাধবে যাতে কনে পক্ষের হার অনিবার্য। কোন কোন ক্ষেত্রে এ সময় বর পক্ষের লোকজন কনেকে অপহরণও করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এ অপহরণ অভিনয়ও হতে পারে। এর পর বেশ কিছু আচার আচরণের পর বর পক্ষের দেয়া নতুন কাপড় চোপড় পরে কনে একটি বাঁশের তৈরী বড় ডালি বা ঝুড়িতে গিয়ে বসবে। বরের ভাই সহ অন্য আত্নীয় স্বজনেরা এ সময় ওই ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে ঘুড়তে শুরু করবে। এ সময় বর তার ভগ্নিপতির কাঁধে চেপে ঝুড়িতে বসা আপদমস্তক মুন্ডিত কণের সিঁথিতে শালপাতার পাত্র থেকে সিদুর পড়াতে পারলেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে যায়। এর পর বর কনের পোষাকে একটি গিট বেধে দেওয়া হয় যা কনে বরের বাড়ীতে যাওয়ার আগে খোলা যাবে না। এই গিট বাধার পর কনের মা মেয়ে জামাই ও 'লমতার' পা ধুয়ে দিবে। এর পর খাওয়া দাওয়া ও হাড়িয়া উৎসব শুরু হবে যা সারা রাত চলবে। বিয়ের সময় কনের বাড়ীর উঠানটি ছামিয়ানার মতো করে শালপাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সাঁওতালি বিয়েতে বরপক্ষকে মূল্য দিয়ে কনেকে কিনে নিতে হয়। অবশ্য এর দাম সাড়ে বারো টাকা কিম্বা ক্ষেত্র বিশেষে এককুড়ি পাঁচ টাকা মাত্র। বিয়ের পর কনেকে অবশ্যই বর পক্ষের সাথে পায়ে হেটে শ্বশুর বাড়ী যেতে হবে।

সাঁওতালদের কেউ মারা গেলে তারা তাকে কবরস্থ করে। এর পর সন্ধায় বাড়ীতে মোরগ পোলও করে বাড়ীর সকলে সহ আত্নীয় স্বজনদের খাওয়ানো হয়। এ খাবারের একটা অংশ মৃতের আত্নার খাবারের জন্য রান্নাঘরের মাঝখানে রেখে দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাষ অনুসারে এ খাবারের কিছু অংশ অবশ্যই মৃতের আত্না খেয়ে থাকে বলে পরের দিন ওই খাবার কিছুটা কমে যায়। মৃতের আত্নার উপসি'তি পরীক্ষার জন্য ঘরে ছাই বিছিয়ে রাখা হয়। তাদের বিশ্বাষ মতে এই ছাইয়ে মৃতের আত্নার পায়ের ছাপ দেখা যায়। খাবারের অবশিষ্ট অংশ পরদিন কুকুর ও বিড়ালকে খেতে দেওয়া হয়। এই বিশেষ রীতিটি আদিকাল থেকে এখনো সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত আছে যাকে শিক্ষিত সাঁওতালরা আদি অষ্ট্রেলিয় প্রথার অংশ হিসাবে বর্ণনা করেন।

আদি সাঁওতাল জনগোষ্ঠির পোষাক ছিল বৈচিত্রময়। পুরুষেরা পড়তো লেংটি আর মেয়েদের পোষাক ছিল বিচিত্র নক্সার মোটা কাপড়ের দুখন্ড বস্ত্র। আধুনিক কালে মেয়েদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ধারায় পেচানো শাড়ি পড়তে দেখা যায়। কৃষিজীবি পুরুষেরা ধুতি-লুঙ্গি পরে থাকে। শিক্ষিতদের মধ্যে আধুনিক যুগের প্যান্ট-শার্ট পড়তে দেখা যায়।

উত্তর বঙ্গের মধ্যে নওগাঁ জেলায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠির বাস সর্বাধিক। এদের সঠিক সুমারি পাওয়া না গেলেও ধারনা করা হয় নওগাঁ জেলায় প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল জনগোষ্ঠি বসবাস করে।
Source:  http://kzaman007.blogspot.com/2009/01/blog-post.html
*******************************************************************
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment