Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

প্রতিক্রিয়া :কী হবে সাঁওতালি বর্ণমালা

 
সমর এম সরেন | তারিখ: ০৬-০২-২০১৩
সাঁওতালি ভাষার বৈচিত্র্যময়তা সত্যিই বিস্ময়কর। এ ভাষাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস ও প্রবহমান একটি ঐতিহ্য। এর পরেও সরকারি পক্ষ থেকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ মোতাবেক ২০১৪ সাল থেকে মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় এ ভাষার বর্ণমালাবিষয়ক বিতর্ক শুরু করেছে বিশেষ একটি মহল। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সাঁওতালি ভাষার শিশুরা কোন বর্ণমালায় পড়বে—অলচিকি, বাংলা নাকি রোমান বর্ণমালায়। দক্ষিণ ভারতের উড়িষ্যায় ১৯২৫ সালে সাঁওতালি বর্ণমালা হিসেবে প্রচলন করেন পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু। কিন্তু ভারতে এ বর্ণমালাটি রাজনৈতিক আবেদন পূরণে সক্ষম হলেও ব্যাকরণগত আবেদনে পরিপূর্ণতা আনতে সক্ষম হয়নি। ফলে আজও ভারতবর্ষেই এ বর্ণমালার বিতর্কের অবসান ঘটানো যায়নি (সূত্র হিন্দি টাইমস, ৮.৮.১২)। অপর দিকে, বাংলাদেশে অলচিকি বর্ণমালা চর্চার কোনো প্রেক্ষাপট নেই।

বাংলাদেশে সাঁওতালি ভাষার লেখ্যরূপের চর্চার ইতিহাসটিও দীর্ঘকালের। কিন্তু ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ প্রথম আলোয় শ্রদ্ধেয় পাভেল পার্থর প্রকাশিত কলাম ‘সাঁওতালি ভাষায় বর্ণমালা কী হবে?’ লেখাটিতে তথ্যের অপরিপূর্ণতা সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে মর্মাহত করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘রাজশাহীতে শুরু হয় সাঁওতালি ভাষার প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয়।’ আমার জানামতে, ১৯৯৯ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় বর্ষাপাড়া গ্রামে গ্রামীণ ট্রাস্টের সহযোগিতায় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বাংলা বর্ণমালায় একটি পাইলট স্কুলে সাঁওতালি ভাষার কার্যক্রম করেছে এবং তা মাত্র তিন বছর স্থায়ী হয়। অপর দিকে, সাঁওতালি ভাষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম লক্ষ করা যায় জয়পুরহাট জেলার বেগুনবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯০৫ সালে, বেনীদুয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে, নিকেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। এ ছাড়া মিশনারি স্কুলগুলোতে এখন পর্যন্ত এর চর্চা রয়েছেই। তবে তা রোমান হরফে। আবার তিনি কোনো পরিসংখ্যান ব্যতীতই উল্লেখ করেন যে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত সাঁওতাল সম্প্রদায় সাঁওতালি ভাষা রোমান হরফে লেখার পক্ষে নয়। অথচ ২০১০ সালের একটি গবেষণামূলক রিপোর্ট ‘The Santali Cluster in Bangladesh : A Socio Linguistic Survey’ বলছে, সাঁওতালদের শতকরা ৫৫ জন লিখিত রূপ হিসেবে রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করেন। শতকরা মাত্র ১১ জন বাংলা বর্ণমালা ও শতকরা ৩২ জন এ পর্যন্ত কোনো বর্ণমালাই ব্যবহার করেননি। এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে পাভেল পার্থর মন্তব্য একটি বড় ধরনের অমিল।
বাংলাদেশে বাংলা বর্ণমালার পক্ষে সর্বজনীন একটি আদিবাসী সংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ দাবি তুললেও কোনো সাঁওতালি সংগঠন এ পর্যন্ত এর পক্ষে সমর্থন জানায়নি। বাংলায় সাঁওতালি উচ্চারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। ভয়েসলেস উচ্চারণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে শুধু ‘ঃ’ এবং ‘হ’ বর্ণ দুটিকে। অথচ সাঁওতালিতে আরও ভয়েসলেস ধ্বনির সন্ধান পাওয়া যায়। উপরন্তু বাংলায় দুটি ভিন্ন শব্দের একই রকম উচ্চারণ সান্তালি ভাষাটিকে সাংঘর্ষিক করে তোলে।
পাভেল পার্থ ১৯২৫ সালের একটি বিতর্ক উল্লেখ করেছেন যে ফাদার হফম্যান ব্যাঞ্জনবর্ণের অবদমিত স্বরগুলোকে ঘোষ বর্ণ জ, দ এবং ব-এর ডি, জে, বি চিহ্নের সাহায্যে লেখার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে প্রস্তাব আজও গৃহীত হয়নি। কেননা, সেখানে বিতর্কের খাতিরেই উক্তিটি উল্লেখ করা হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় যে এই বর্ণমালার ইতিহাস অলচিকি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ১৮৪৫ সালে রেভা. জে ফিলিপস এই বর্ণমালা দ্বারা সাঁওতালি লেখার প্রচলন করেন। আগে মূল রোমান লিপি দ্বারা সাঁওতালি উচ্চারণ খুব একটি সম্ভব হতো না। তাই ১৮৬৩ সালে ড. সি আর লেপলাস এই বর্ণমালাটি সংশোধন করেন। পরবর্তী কালে সান্তাল লিটারেরি সোসাইটি এটিকে আইপিএর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দীর্ঘ স্বরধ্বনিসমূহ সংশোধন করে। ফলে এটি মূল রোমান থেকে আলাদা হওয়াতে অনেকেই এটিকে সাঁওতালি বর্ণমালা বলেই বিবেচনা করেন। পাভেল পার্থ হেরাল্ডের একটি সূত্র দিয়ে বলেছেন, রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষার স্বরধ্বনিগুলো ঠিকমতো লেখা যায় না। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের সমস্যার কোনো অস্তিত্বই লক্ষ করা যায় না।
বাংলাদেশে রোমান বর্ণমালায় সাঁওতালি ভাষা চর্চার ইতিহাস প্রায় ৯০ বছরের। বাংলাদেশে সাঁওতালি ভাষার সাহিত্যচর্চা হয়েছে রোমান দ্বারাই। মিশনারি ও এনজিও সহযোগিতা ব্যতীতই এ বর্ণমালায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত অসংখ্য বই রয়েছে। এ দেশে প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের উদাহরণ দিতে পারি, যেগুলো শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও সাড়া জাগিয়েছে। যেমন হাড়মাওয়াক আতো (উপন্যাস), মারে হাপড়ামকোয়াক কাথা (সাঁওতাল সমাজব্যবস্থা বিষয়ক), কাথা পাড়িয়ান (সাঁওতালি অভিধান), সান্তাল পারগানা ইত্যাদি। এ ছাড়া এ বর্ণমালায় সান্তালস সিভিল ল নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই এ দেশে সান্তালি ভাষার ম্যাগাজিন বের হতো এবং আজও সেই প্রকাশনার ধারা অব্যাহত রয়েছে। অপর দিকে বাংলাদেশে বাংলা বর্ণমালায় শিশুদের পড়ার বই এবং বর্ণমালা চর্চার বই ছাড়া অন্য কোনো সাহিত্য চর্চার প্রমাণ নেই বাংলাদেশের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে। মাত্র চারটি বই বাংলা বর্ণমালায় রয়েছে। এনজিওর সহযোগিতায় শিশুদের জন্য লেখা এ বইগুলোর সাঁওতাল লেখকদের অনেকেই আজ রোমানের পক্ষে কথা বলছেন। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বাংলাদেশে বাংলা বর্ণমালায় সাঁওতালি কোনো তথ্যপ্রযুক্তির চর্চা করা হয়নি। আমার উদ্ভাবিত সাঁওতালি ইউনিকোড টাইপিং সফটওয়্যার হড়কাথাসহ সাঁওতালি উইকিপিডিয়া, সাঁওতালি ভাষার ফেসবুক অ্যাপ্লিকেশনসহ সবই করা হচ্ছে এই রোমান বর্ণমালায়।
তাই এ মুহূর্তে এ ধরনের ভাষাবিষয়ক স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাঁওতাল জনগণ সর্বজনীন আদিবাসী সংগঠন ও কোনো বুদ্ধিজীবীর তুলনায় সাঁওতাল গোত্রপ্রধান এবং সাঁওতাল সংগঠনের সিদ্ধান্তগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের এই যুক্তি ও কর্মপন্থা অত্যন্ত যৌক্তিক। কেননা, ভাষা তাদের, সিদ্ধান্তও তাদের। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক আবেগ দিয়ে নয়, বরং ব্যাকরণগত গ্রহণযোগ্যতা ও উচ্চারণগত যোগ্যতা বিচার করেই বর্ণমালা নির্বাচন করাটাই সঠিক বলে মনে করি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাঁওতাল শিশুদের ঝরে পড়ার হার বন্ধ করতে হলে সঠিক উচ্চারণসংবলিত বর্ণমালাই পড়ানো উচিত। সেদিক থেকে রোমানের যোগ্যতাই সবচেয়ে বেশি।

সমর এম সরেন: সাধারণ সম্পাদক, সান্তালি উইকি বাংলাদেশ; উদ্ভাবক, সান্তালি ইউনিকোড টাইপিং সফটওয়্যার, হড়কাথা।
samarsoren@gmail.com
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment