Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

সাঁওতালদের কারামপুরাণ

সালেক খোকন, সময়টা, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার তিথি। কারামপূজার দিন। সন্ধ্যা হতেই সাঁওতাল পাড়াটিতে থেমে থেমেই বাজছিল ঢোল-মাদল। কারামগাছের ডাল কেটে এনে পুঁতে দেওয়া হয়েছে গ্রামপ্রধানের বাড়ির উঠানে। ডালের চারপাশে বাঁশের ঘের এবং তাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে শাপলাফুল। ফুল ছিটিয়ে প্রণাম আর লাল মুরগি বলি দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে। অতঃপর শুরু হয় কারামপুরাণ পাঠের আসর।

দিনাজপুরের মহেশপুর গ্রাম। সাঁওতাল আদিবাসীদের বাস এখানটায়। আদিবাসী এ গ্রামের প্রধানের নাম বাঠু সরেন। সবাই ঘিরে বসে তাঁকে। কারাম গোঁসাইকে স্মরণের অংশ হিসেবে তিনি শোনান কারাম কাহিনিটি। কাহিনিতে কারাম গোঁসাইয়ের নাম উঠলেই সাঁওতাল নারীরা মুঠো মুঠো জুঁই ফুল ছুড়ে দেয় কারাম ডালের দিকে। সবার সঙ্গে আমরাও শুনি সাঁওতালদের কারামপুরাণের কাহিনিটি। ‘যমজ দুই ভাই কার্মু ও ধার্মু। কার্মু বড়। ধার্মু ছোট। তাদের বয়স যখন দশ তখন তাদের বাবা মারা যায়। ফলে চরম দারিদ্র্য নেমে আসে পরিবারটিতে। দুই ভাই তখন ভিক্ষা করে জীবন চালায়।


একদিন তারা ভিক্ষা করতে যায় চাম্পাগড় ও চায়নগরে। সে দিন প্রখর রোদ ছিল। ফলে দুই ভাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চাম্পাগড়ের খুব কাছেই ছিল একটি নদী। নদীর ধারে ছিল একটি কদমগাছ। ক্লান্ত ধার্মু গা এলিয়ে দিল সে গাছের ছায়াতলে। ঘুমের মধ্যে তাকে দেখা দেন ‘কারাম গোঁসাই’। বললেন, ‘ওহে ধার্মু, কত দিন আর এভাবে ভিক্ষা করবে। কারামগাছের ডাল পুঁতে কারামপাতার মাদল তৈরি কর, তিনবার গড় হয়ে তা প্রণাম কর এবং ওই ডালের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাক।’ আরও বললেন, ‘কদমগাছের নিকট আছে একটি গাভি। পাথরের চাতালে বেনাঘাসের মাঠে আছে মাথায় বাঁধার একখানা কাপড়। আর নদীর ধারের ডুংরীতে বাঁশের ঝাড়ে রাখা আছে একটি বাঁশি। সেগুলো তুমি নিয়ে যাও আর প্রতিদিন নদীর ধারে এসে কারামডাল পুঁতে আমাকে পূজা দাও। তাহলে আমি তোমাদের অনেক বেশি বেশি ধন দেব।’ ঘুম ভাঙতেই ধার্মু দেখল, নদীর ধারে সত্যিই একটি কারামগাছ। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশমতোই সে ওই গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পুঁতে তিনবার গড় হয়ে প্রণাম ও নমস্কার করে। অতঃপর চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। হঠাৎ সে দেখল তার কাছে চলে এসেছে একটি গাই গ রু। গাইটিকে সঙ্গে নিয়ে, ডুংরীর বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশি নামিয়ে, বেনাঘাসের ওপর থেকে পাওয়া কাপড় দিয়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, সে ফিরল বাড়িতে। এভাবেই ধার্মু প্রতিদিন নদীর পাড়ে এসে কারামগাছের ডাল পুঁতে প্রণাম করে আর চারপাশে ঘুরে ঘুরে কারাম গোঁসাইকে স্মরণ করে। সঙ্গে থাকে ওই বাঁশি আর পাগড়ি। এতে দিনে দিনে তার গরু বাছুরের সংখ্যা যায় বেড়ে। সে হয়ে ওঠে সম্পদশালী। একবার ভাই কার্মু ছোট ভাইয়ের রাখালি দেখতে গেল মাঠে। আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দেখল, ধার্মু নদীর ধারে কারামডাল পুঁতে কারামপাতার মাদল মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। আর তার দিকে তাকিয়ে আছে একটি গাই গরু। এ দৃশ্য দেখে কার্মুর হিংসে হলো। বাঁ হাত দিয়ে সে ওই কারামডালটি উপড়ে ফেলল। অতঃপর তা বাড়িতে এনে ফুটন্ত দুধে ডুবিয়ে নদীর জলে ডালটিকে নিক্ষেপ করল। ওই ঘটনার পর থেকে তাদের জমিতে ধান হলো না। গরু-বাছুরগুলোও গেল মরে। ফলে তারা ধীরে ধীরে আবারও দরিদ্র হয়ে পড়ল। সে সময় দুই ভাই গেল ধান রোপণের কাজে এক ধনীর বাড়িতে। কাজের ফাঁকে সবাইকে মুড়ি খেতে দেওয়া হলো। কিন্তু অন্যদের দিতে দিতেই মুড়ি শেষ হয়ে গেল। ফলে নাওয়া-খাওয়া ছাড়াই কার্মু ও ধার্মু দিনভর ধান রোপণ করল। শেষে গেল মজুরি আনতে। কিন্তু এবারও ঘটল একই ঘটনা। অন্যদের দিতে দিতেই টাকা গেল ফুরিয়ে। মালিক বললেন, ‘আজ টাকা শেষ, তোমরা টাকা পাবে কাল।’ কথা শুনে দুই ভাই বড়ই কষ্ট পেল। ‘মজুরি না পেলে আমাদের লাগানো চারা সব তুলে দেব’- এমন সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা মাঠের দিকে ছুটল। সে সময় পথে তাদের দেখা হলো এক বৃদ্ধের সঙ্গে। বৃদ্ধ দুই ভাইকে থামালেন। সব শুনে তিনি বললেন, ‘কারাম গোঁসাইকে বাঁ হাত দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই তোমাদের এক কষ্ট।’ তিনি কার্মু ও ধার্মুকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘জালাপুরী দ্বীপের চন্দন জঙ্গলে পাবে কারাম গোঁসাইকে। আজই তাকে খুঁজে আন। নইলে সপরিবারে অনাহারে মরবে।’ কথাগুলো বলেই ওই বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়ে গেল। দুই ভাই তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। পেটে খিদে নিয়ে তারা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে পড়ল কারাম গোঁসাইয়ের খোঁজে। যেতে যেতে তারা পৌঁছাল উজারডি গ্রামে। সেখানকার এক কাঁঠালগাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিল কার্মু ও ধার্মু। হঠাৎ কাঁঠালগাছটি তাদের প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ হে?’ জবাবে ধার্মু বলল, ‘আমরা কারাম গোঁসাইকে খুঁজতে যাচ্ছি।’ শুনে, কাঁঠালগাছ অনুরোধ করে বলল, ‘এ গাছের নিচে বহুদিন ধরে যে টাকা পোঁতা আছে, আমি আর সেই টাকা দেখাশোনা করতে পারব না। কারাম গোঁসাইয়ের দেখা পেলে আমার কথাটাও একটু বলো।’ সেখান থেকে দুই ভাই এলো ঝলদা গ্রামে। সে গ্রামে ছিল এক ধনী লোক। তিনি কার্মু ও ধার্মুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কোথায় যাও ভাই?’ উত্তরে তারা বলে, ‘আমরা কারাম গোঁসাইকে খুঁজতে বের হয়েছি।’ লোকটি বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আমি আর ধন জমিয়ে রাখতে পারছি না। তোমরা আমার কথাটিও তাকে বলে দিয়ো।’ দুই ভাইয়ের পেটে খিতে। অথচ ওই গ্রামেও তারা পেল না কোনো খাবার। ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে তারা এলো অযোদিয়া গ্রামে। এ গ্রামে ছিল এক ধনী গোয়াল। তার সঙ্গে দেখা হতেই তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ হে?’ কার্মু ও ধার্মুর জবাব শুনে তিনি অনুরোধ করে বলেন, ‘কারাম গোঁসাইকে বলে দিয়ো, আমি আর বেশি গরু গোয়ালে রাখতে পারছি না। তাদের গোবর ফেলতে ফেলতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। এত গরু পোষা আর সম্ভব নয়।’ গোয়ালের কথা শুনে দুই ভাই সামনে এগোতে থাকল। কিছুদূর যেতেই পথে পড়ল খর¯্রােতা এক নদী। নদীর নাম গাংনদী। সে নদীর একটি রাঘব বোয়াল মাছ কার্মু ও ধার্মুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে ভাই।’ তারা আগের মতোই জবাব দিল। শুনে বোয়াল মাছ দুঃখ করে বলে, ‘এ জন্মে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। আমার যেন তাড়াতাড়ি মরণ হয়। কারাম গোঁসাইয়ের দেখা পেলে তাকে আমার কথাটিও বলো।’ দুই ভাই সেখান থেকে এলো জালাপুরী সাগরের কাছে। বিশাল ও উত্তাল সাগর তারা কীভাবে পার হবে? এই ভেবে কার্মু ও ধার্মু সাগরপাড়ে বসেই কাঁদতে কাঁদতে গাইল: (যার ভাবার্থ) কারাম মাগো দয়া করো মাগো আমাদের কারাম মাগো তুমিই দিশা দাও আমাদের কারাম মাগো কারাম গোঁসাই কারাম মাগো এই জালাপুরী পার হতে না পারলে কারাম মাগো এই জলার জলেতে কারাম মাগো প্রাণ বিসর্জন দেবো আমরা। দুই ভাইয়ের কান্না শুনে সাগরপাড়ে আসে এক কুমির। সব শুনে কুমির তাদের জালাপুরী পার করিয়ে দিতে রাজি হয়। কার্মু ও ধার্মু তখন কুমিরের পিঠে চড়ে বসে। যেতে যেতে কুমির বলে তার দুঃখের কথাটি, ‘আমি কোনো কিছু ধরতে গেলেই তা পালিয়ে যায়। কারাম গোঁসাইকে একটু বলো, আমার শিকার যেন আর মুখ থেকে ফসকে যেতে না পারে।’ জালাপুরী পার হয়ে কার্মু ও ধার্মু পৌঁছে গেল চন্দন পাহাড়ের বনে। সেখানে সোনার সিংহাসনে বসে ছিলেন কারাম গোঁসাই। ক্ষুধার্ত দুই ভাইকে দেখে তার দয়া হলো। প্রথমেই কারাম গোঁসাই তাদের সুমিষ্ট ফল খেতে দিলেন। অতঃপর তিনি অবশ্যই তাদের কাছে ফিরে যাবেন- এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন দুই ভাইকে। কারাম গোঁসাইয়ের উদ্দেশে কার্মু ও ধার্মু একে একে বলেন কাঁঠালগাছ, গোয়ালা, ধনী লোক, রাঘব বোয়াল ও কুমিরের মিনতিগুলো। সব শুনে কাঁঠালগাছের বিষয়ে কারাম গোঁসাই বলেন, ‘পুঁতে রাখা ওই টাকাগুলো তোমাদের। তোমরা সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ো।’ গোয়ালার কথা উঠতেই বললেন, ‘তাকে বলে দিয়ো, আর একবার গরুর গোয়ালে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করে সে যেন চলে যায়। ফেরার পথে ওই গরুগুলো তোমরাই নিয়ে যেয়ো।’ ধনী লোকের আকুতির উত্তরে কারাম গোঁসাই বলেন, ‘ওকে বলে দিয়ো, উনুনে ভাতের এঁটো ঢুকিয়ে আর ভাতের হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে জ্বালানি কাঠ যেন পা দিয়ে ঠেলে দেয়। আর তার সব ধন তোমাদের দিলাম।’ রাঘব বোয়ালের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা তাকে বলে দিয়ো, সে শিগগিরই মাঝ নদীতে মারা যাবে। তার আর কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।’ সব শেষে দুই ভাই জানালেন জালাপুরীর কুমিরের দুঃখের কথা। শুনে কারাম গোঁসাই কার্মু ও ধার্মুকে বলেন, ‘তাকে বলে দিয়ো, আজ থেকে কোনো কিছু সে ধরতে গেলে তা আর পালাতে পারবে না। সে হবে জালাপুরীর রাজা।’ কারাম গোঁসাইয়ের নির্দেশগুলো পথে পথে সবাইকে বলে, দুই ভাই ফিরল বাড়িতে। সঙ্গে আনলো টাকা-পয়সা, ধনসম্পদ আর গরু-বাছুর। এভাবে তারা আবার সম্পদশালী হয়ে উঠল এবং কারাম গোঁসাইয়ের আশীর্বাদে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকল।’ এ ঘটনার পর থেকেই সাঁওতালেরা কারামপূজা পালন করে আসছে। বাঠু সরেনের কথা থামতেই শুরু হয় কারাম নাচ। একদল সাঁওতাল নারী পায়ে পা মিলিয়ে হাত ধরাধরি করে নাচতে থাকে। মাদলের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। দিং দাতাং ভেতাং মুড়–ম দাং দাতাং ভেতাং গুড়–ম দাং…। এ দেশে নানা অবহেলা ও বঞ্চনার মাঝে কাটছে সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবন। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। তবু কারামপূজা তাদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের পূজা। তাই এ সময়টাতে সাঁওতাল আদিবাসীরা কার্মু ও ধার্মুর কাহিনির সঙ্গে মিলিয়ে নেয় নিজেদের জীবনের অপূর্ণতাগুলোকে।
Source: http://www.kagoj24.com/?p=191
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment