Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

অভিমত ॥ আদিবাসী বিতর্ক ॥ সমাধান জরুরী

বুধবার, ২৩ জুলাই ২০১৪, ৮ শ্রাবণ ১৪২১
রিজভী রাইসুল জয়
স্বাধীনতার দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর অতিবাহিত হলেও এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর নামকরণে কোন সুষ্ঠু সমাধান করতে পারেনি। কখনও উপজাতি, কখনও আদিবাসী, কখনও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী এমনই বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সময় অভিহিতকরণের প্রয়াস চালিয়েছে রাষ্ট্রের অধিপতিশীল ক্ষমতা কাঠামো। আদিবাসী, উপজাতি নাকি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী পরিচিতি নির্মাণে সৃষ্ট গোলকধাঁধায় আজ পর্যন্ত আসেনি কোন সুষ্ঠু সমাধান।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী হিসেবে এ দেশের ভূ-খণ্ডে বাঙালী ভিন্ন অন্য কোন জাতিসত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাস করে এমন অনেক পাহাড়ী ও সমতলী জাতিসত্তার মানুষ নিজ স্বতন্ত্র পরিচয়ের দাবিতে এ প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। মূল জনস্রোত বাঙালীর বাইরে বাংলাদেশের গাড়ো, সাঁওতাল, মুরং, হাজং, কোচ, মনিপুরিসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেকে বাংলাদেশী হলেও বাঙালীর বাইরের জনগোষ্ঠী নিজ জাতিগত পরিচয়ে আত্মস্বীকৃতি পেতে উদগ্রীব। দীর্ঘকাল ধরে ঝুলে থাকা এ সমস্যা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের কোন টু শব্দটি নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান আশ্রয় লাভের অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। সংবিধানে আরও বলা হয়েছে ধর্মবর্ণগোষ্ঠী, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকবে। এখানে আইনের দৃষ্টিতে সমান ও সুযোগের সমতা বলতে শাসক-শাসিত,ক্ষুদ্র-বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেই একই আইনের অধীনে থাকবে এবং অভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। কিন্তু মৌলিক অধিকার অংশের এই অধিকার থাকা সত্ত্বেও আদিবাসী সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে উল্লেখ করে নিজস্ব পরিচয়ে এদেশে বসবাস করার কোন অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান দেয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১০ সালে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জনগণকে উপজাতি বলে সম্বোধন বিলুপ্ত করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করার বিধান সংসদে পাশ হয়। তবে কোন জাতিগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র বলে সম্বোধন করার যৌক্তিকতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
ইংরেজী ওহফরমবহড়ঁং শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘আদিবাসী’। আদিবাসীর ব্যাখ্যায় জাতিসংঘের স্পেশাল ড্যাপেটিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোরের যে সংজ্ঞা জাতিসংঘ কার্যকরি সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাতে বলা হয়, ‘আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদের বোঝায় যাদের ভূখ- প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকে নিজস্ব সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বিদ্যমান, যারা নিজেদের ঐ ভূ-খ-ে বা ভূ-খ-ের অংশবিশেষে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। বর্তমানে তারা সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য,সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্বপুরুষের ভূ-খ- ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যত বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আবার ওখঙ এর ১৬৯ নং পড়হাবহঃরড়হ এ আদিবাসী বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘স্বাধীন দেশগুলোর জাতিসমূহ যারা এই মর্মে আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত যে তারা ঐ দেশটিতে কিংবা উপনিবেশ স্থাপন কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণকালে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যারা তাদের আইনসঙ্গত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশবিশেষ বা সম্পূর্ণ লালন করে চলেছে।’ উপরোক্ত সংজ্ঞা দুটির আলোকে তারাই আদিবাসী ।
ক্স যারা কোন উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ঐ ভূ-খণ্ডে বাস করছিল।
ক্স যারা ঐ ভূ-খণ্ডে নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করেছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমার খুব ক্ষুদ্র কিছু অংশে বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি থাকলেও বাংলাদেশের সমগ্র ভূ-খণ্ডের ওপর কখনই তাদের দখল ছিল না এবং বাঙালীরা কখনই এ ভূ-খ- কোন চাকমা, ত্রিপুরা, হাজং অথবা সাঁওতালের কাছ থেকে দখল করে রাজত্ব কায়েম করেনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, মোগল শাসনামলে প্রতিবেশী বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং মঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠী থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক আশ্রয় লাভের জন্য অভিবাসী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আশ্রয় নেয়। তবে একই সঙ্গে এ বিষয়টিও সত্য যে, তাদের আগমনের পূর্বে পাহাড়ী অঞ্চলে বড় কোন বাঙালী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
আবার, আদিবাসী স্বীকৃতি দাবির যুক্তিতে বলা হয়, প্রাক ঔপনিবেশিক আমলে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলার কোন অংশ ছিল না। সে সময় বর্তমান চট্টগ্রামের অধিকাংশ অংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল স্বাধীন সামন্ত রাজ্য। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে ঔড়ধ উব ইধৎৎড়ং নামের এক পর্তুগীজ মানচিত্রকরের আঁকা একটি মানচিত্র থেকে তৎকালীন চাকমা রাজ্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে। আবার ভারত বিভক্তির পূর্বে এই অঞ্চলে লোকসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ ছিল বাঙালী। এই সব তথ্য প্রমাণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদের বসবাস পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর তুলনায় সাম্প্রতিককালের। ইতিহাস পর্যালোচনায় এটিও প্রমাণিত, পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালীর তুলনায় অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি পুরনো বা আগেকার। সেক্ষেত্রে আদিবাসীর উপরোক্ত সংজ্ঞানুযায়ী তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা পাহাড়ের নাকি সমগ্র বাংলাদেশের আদিবাসী বলা হবে এখানে তা প্রচলিত জ্ঞানকাঠামোকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
আবার আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আদিবাসী বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের প্রথম জনগোষ্ঠীর কথা। এখন যদি সংবিধান ও রাষ্ট্র, পাহাড় ও সমতলের কিছু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাহলে রাষ্ট্রের ইতিহাস জটিলতার সম্মুখীন হবে। আর আঞ্চলিক স্বীকৃতি দিলে, বিভিন্ন অঞ্চলে যে আরও নতুন নতুন আদিবাসীর দাবি উঠবে না তার নিশ্চয়তা নেই।
১৯৭২ সালের অক্টোবরে যখন সংসদে দেশের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয় সেখানে জাতীয়তা নির্ধারণে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালী বলে গণ্য হবেন। এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন মানবেন্দ্র লারমা। এরপর তিনি পাহাড়ী কিছু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে জুম্ম জাতির স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করেন।
আবার, রাষ্ট্রের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দিলে ওখঙ কনভেনশন মানার নৈতিক দায়িত্ব এসে বর্তাবে বাংলাদেশের ওপর। ওখঙ কনভেনশনের ১৬৯ ধারা (৪) এ বলা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসনের আওতায় আনতে হবে।
আবার কনভেনশনের ১৫.১ ধারায় বলা হয়েছে যে, আদিবাসীরা যে অঞ্চলে বসবাস করে সে অঞ্চলের প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে।
বাংলাদেশ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীকে উপজাতির পরিবর্তে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে সম্বোধনের বিধান প্রণয়ন করে। কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে, যে রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস বাঙালী ছাড়াও অসংখ্য চাকমা, মারমা, গাড়ো, সাঁওতালদের রক্তে রঞ্জিত, সেই মানুষগুলোকে ক্ষুদ্র বলে সম্বোধন কেবল আধিপত্যশীল জ্ঞান কাঠামোর চর্চারই প্রতিফলন ঘটায়।
সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার নিশ্চিত করা একটি সভ্য রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। আদিবাসী, উপজাতি না ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী সম্বোধনের এই বিতর্ক না করে যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি এমন এক পরিবেশ যেখানে সংখ্যালঘু এই মানুষ নিজেদের সম্পূুর্ণরূপে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে ভাবতে পারবে, তাদের নিজ পরিচয়ে যথাযথ সম্মান ও অধিকার নিয়ে এ দেশের ভূ-খণ্ডে বাস করতে পারবে তবেই এ বিতর্ক অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যাবে।

Source: http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=13&dd=2014-07-23&ni=179907
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment