গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে আখ মৌসুমে পুলিশি প্রহরায় বীজ আখ কাটতে যায় রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার-সংশ্লিষ্টরা। এসময় পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালসহ বেশ ক’জন বাঙালি দখলদারের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমভ্রম (৩৫) নামে একজন সাঁওতাল মারা গেছে।
গোবিন্দগঞ্জ থানা -পুলিশের নিকট এ বিষয়ে কোনও তথ্য না থাকলেও দিনাজপুর কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেদোয়ানুর রহিম বাংলা ট্রিবিউনকে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, শ্যামল হেমভ্রমের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে মর্গে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার লাশ নিতে কেউ আসেননি।
নিহত শ্যামল হেমভ্রম চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমেস্বরপুরের বাসিন্দা। তিনি দীর্ঘদিন থেকে সাহেবগঞ্জ এলাকায় বসবাস করতেন।
শ্যামল হেমভ্রম নামে ওই ব্যক্তির মারা যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার জানান এব্যাপারে তার কাছে কোনও তথ্য আসেনি। তিনি আরও জানান, ওই ঘটনায় রবিবার রাতে উপ-পরিদর্শক (এসআই) কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে ৩৮ জনের নাম উল্লেখসহ সাড়ে ৩শ’ জনের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। আসামিদের গ্রেফতার করতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ওসি বলেন, চিনিকলের সরকারী জমির দখলদারদের মধ্যে ছিল অধিকাংশই সাঁওতাল।
এলাকায় বসবাসকারী সাঁওতালরা অভিযোগ করেছেন উচ্ছেদ অভিযানের পর স্থানীয় লোকজন তাদের অস্থায়ী ঘরগুলোর টিন, বাঁশ এমনকি গরু-ছাগল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। তবে সোমবার সকাল থেকেই লুটপাটসহ পরবর্তী সংঘর্ষ এড়াতে স্থানীয় সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ওই এলাকায় পাহারা দিয়ে চলেছেন। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষুখামারের ১ হাজার ৮শ ৪২ একর জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে চিনিকল কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। রবিবার সকালে ইক্ষু খামারের শ্রমিক-কর্মচারীরা পুলিশ পাহারায় বাগদা-কাটা সংলগ্ন এলাকার ওই জমিতে তাদের রোপন করা আখ কাটতে যায়। এসময় খামারের ১০০ একর জমি দখল করে থাকা সাঁওতালসহ কতিপয় বাঙালি দখলদাররা তাদের বাধা দেয়। মুখোমুখি অবস্থানের একপর্যায়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হয়। এসময় সাঁওতালদের ছোড়া তীরে ৯ পুলিশ সদস্য বিদ্ধ হন। পরে পুলিশ বেশ কয়েক টিআর সেল ও কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পুলিশের গুলিতে চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হন। উভয় পক্ষের আহত হন মোট ১৭ জন।
এ ব্যাপারে আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন ও সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে মোবাইল ফোনে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেন, পুলিশের ছোড়া গুলিতে তাদের চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে দীজেন টুটু (দিনাজপুর), চরণ সরেন (বদরগগঞ্জ), বিমল কিশকু (ঘোড়াঘাট), শ্যামল হেমভ্রনকে (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)পার্শ্ববর্তী ঘোড়াঘাট এলাকা দিয়ে দিনাজপুর মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রবিবার রাতে মল হেমভ্রম মারা যান। শ্যামল হেমভ্রন দীর্ঘদিন থেকে সাহেবগঞ্জ এলাকায় বসবাস করে আসছেন। তার বুকে গুলি লেগেছিল। গুলিবিদ্ধ বাকিরা এখন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল মোবাইল ফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। তখন থেকে এসব জমিতে উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু দুই বছর আগে এসব জমি ‘বাপ-দাদার’ দাবি করে আন্দোলনে নামে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা এ বছরের ১ জুলাই এ খামারের প্রায় ১০০ একর আবাদি জমিতে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর নির্মাণ করে দখলের চেষ্টা চালায়।
আব্দুল আউয়াল জানান, ইতোমধ্যে দখলদাররা সেখানে ধান ও মাসকালাই চাষও শুরুর পর থেকেই তীর-ধনুক নিয়ে জমি পাহারা দিচ্ছেন। রবিবার চিনিকলের রোপন করা আখ, বীজ হিসেবে সংগ্রহের জন্য কাটতে গেলে সাঁওতালরা বাধা দেওয়ার পর এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
রংপুর চিনিকলের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, ১৯৬২ সালে জমি অধিগ্রহণের সময় চুক্তিনামায় বলা হয়, কখনও চিনিকল বা খামার বন্ধ হলে সেক্ষেত্রে ও’সব জমি সরকারের কাছে চলে যাবে। এরপরও এলাকার কতিপয় সুবিধাবাদি ব্যক্তির উস্কানিতে সাঁওতালরা অবৈধভাবে চিনিকলের জমি দখল করে আছে।
এ প্রসঙ্গে ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, কারও উস্কানিতে আন্দোলন করা হচ্ছে না। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে। সেখানে উল্লেখ ছিল কখনও ও’সব জমিতে আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে প্রকৃত মালিকদের কাছে জমি ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুদিন ধরে ওইসব জমিতে ধান ও তামাকের চাষ চলছে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী জমি ফেরত দেওয়া হয়নি। তাই এভাবে দখলের ঘটনা ঘটে।
ঘটনার পর সোমবার দুপুরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার পরিদর্শন করেছেন।
রবিবার (৬ নভেম্বর) রাতে ওই ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদশক (এসআই) কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখসহ ৩৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার পর গ্রেফতারের ভয়ে আদিবাসী বাড়ীঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এর আগে, রবিবার সন্ধ্যায় পুলিশ ও র্যাব ৩ ঘন্টাব্যাপী এক যৌথ অভিযান পরিচালনা করে চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি থেকে দখলদার আদিবাসীসহ কতিপয় বাঙালিকে উচ্ছেদ করেছে।
এরপর থেকে এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এখন ওই এলাকায় পরবর্তী গোলযোগ এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
উৎস:http://www.banglatribune.com/country/news/155137/%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%93%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B6-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%98%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%A4-%E0%A7%A7-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A7%9F
0 comments:
Post a Comment