Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লি : এবার ধান নিয়ে উৎকণ্ঠা

আশীষ-উর-রহমান ও শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা থেকে | আপডেট: | প্রিন্ট সংস্করণ
[ সাঁওতালপল্লি উচ্ছেদের পর জোরেশোরে চ​লছে সীমানা ঘিরে রাখার জন্য কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ। সাঁওতালদের চাষ করা ধানের খেত চলে যাচ্ছে বেড়ার ভেতরে। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি l সোয়েল রানা
ধান চাষের জমি ঘিরে ফেলছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। ১৩৫ একর জমিতে সাঁওতালদের রোপা ধান কে কাটবে?
জমির কিনার দিয়ে কংক্রিটের খুঁটি পুঁতে নতুন কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছেন চিনিকলশ্রমিকেরা। বেড়ার ভেতরে রোপা আমনের খেত। স্বর্ণা জাতের ধান রোপণ করা হয়েছিল ১৩৫ একরে। ফলনও হয়েছে ভালো। সোনালি শিষ দুলছে হেমন্তের রোদেলা হাওয়ায়। এখন তা ঘরে ওঠার পালা। কিন্তু সেই ধান তোলা নিয়ে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে সাঁওতালদের মধ্যে।
কাঁটাতারের বেড়ার অপর পাশে দাঁড়িয়ে শ্রম-ঘামের ফসল বেহাত হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন সিমন মুর্মু। মাত্র এক রাতের তাণ্ডবে তাঁদের ৩৫০ একর জমির পাকা কলাই আর ১১৫ একর জমির পাট লোপাট হয়ে গেছে। আছে কেবল এই ধান। সেই ধান চলে গেল কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে।
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জে সাঁওতালরা রংপুর চিনিকলের ‘সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামার’-এর জমিতে এবারই প্রথম যৌথভাবে চাষাবাদ করেছিল। চলতি বছরের ১ জুলাই তারা খামারের জমিতে একচালা ছাপরা ঘর তুলেছিল। শ চারেক পরিবার সেখানে বাস করত। ‘সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি’ করে তারা সাঁওতাল এবং পাশের কিছু মুসলিম-হিন্দু পরিবার যৌথভাবে খরচ ও শ্রমের ভিত্তিতে চাষাবাদ শুরু করে।
এক রাতে পাট, কলাই লুট
গতকাল বুধবার খামারের পাশের মাদারপুর, বড় জয়পুর ও ছোট জয়পুর পাড়ার সাঁওতালপল্লিতে কথা হলো সমিতির সদস্য সাঁওতাল ও মুসলিম চাষিদের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সরেন টুডু, চরণ মুর্মু, সুধীর মুর্মু, আলবিনা হাসদা, ইনিয়স সরেন, আবদুল খালেক, লুৎফর রহমানসহ অনেকে। তাঁরা বললেন, সমিতির মাধ্যমে তাঁরা ১১৫ একরে পাট চাষ করেন। এই পাট তাঁরা কাটেননি।
বিএডিসির সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল পাটের বীজ বিক্রির জন্য। প্রতি কেজি বীজের দাম ১২০ টাকা। প্রতি বিঘায় ন্যূনতম চার কেজি করে বীজ হয়। সে হিসাবে ১ হাজার ৩৮০ মণ বীজ হতো। দাম হতো ৬৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। বীজ কাটার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তাঁরা।
মাষকলাই বুনেছিলেন ৩৫০ একর অর্থাৎ ১ হাজার বিঘার ওপর। কিছু জমিতে কলাই তোলাও শুরু হয়েছিল। এ ছাড়া প্রায় সবাই এক-দুই বিঘা করে জমিতে ব্যক্তিগতভাবে শীতের সবজির চাষ করেছিল। পাট ও কলাইতে ক্ষতি ২ কোটি ২৪ লাখ টাকার বেশি।
কার গোলায় উঠবে ধান
এখন খামারের পশ্চিম পাশে আছে শুধু সাঁওতালদের চাষ করা ১৩৫ একরের রোপা আমন। গতকাল তাঁরা জানালেন, আর দুই সপ্তাহে সেচ দিয়ে রাখতে পারলে বিঘাপ্রতি ২২ থেকে ২৫ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেত। কম হলেও ১৫ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া গেলে ফলন হবে ৬ হাজার ৬০০ মণ। খরচের হিসাব লেখা ছিল সমিতির খাতায়। ঘরের সঙ্গে সেই খাতাও পুড়ে ছাই। কথা ছিল সবার খরচের পরিমাণ অনুসারে ফসল বিক্রি করে টাকা সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। পাট, কলাই, সবজি—সব শেষ। সেই জমিতে এখন চিনিকলের ট্রাক্টরগুলো চাষ দিচ্ছে। আখ লাগানো হচ্ছে।
আপাতত পশ্চিম অংশে বেড়া
খামারের চারপাশের সীমানা ১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে আপাতত পশ্চিম অংশে কোটাবাড়ি থেকে বড় জয়পুর পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল আউয়াল ও উপমহাব্যবস্থাপক (ফার্ম) আলমগীর হোসেনের সঙ্গে খামারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়। তাঁরা জানালেন, আপাতত পশ্চিমাংশে বেড়া দেওয়া হচ্ছে। পরে পুরো খামারে বেড়া দেওয়া হবে। সাঁওতাল বা আশপাশের বাসিন্দারা এই খামারে গবাদি পশুপাখি চরায়, আরও নানাভাবে খামারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। তাদের জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হবে। কয়েকটি প্রবেশপথ থাকবে।
মাঠের ধান কাটা প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মানবিক বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন অনেকে চাষি হিসেবে দাবি করছে। প্রকৃত চাষিদের তালিকা করে প্রশাসনের সহায়তায় ধান কাটার বিষয়টি বিবেচনা করছেন তাঁরা।
খামারের জমির বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে মোট জমি ১ হাজার ৮২৪ একর। ১৯৫৪ সাল থেকে হুকুমদখল শুরু হয়ে ১৯৬২ সালে চিনিকলের কাছে এসব জমি হস্তান্তর করা হয়। এখানে শুধুই ইক্ষু চাষ করতে হবে বলে একটি কথা প্রচার করা হচ্ছে, তবে তা ঠিক নয়। এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যেকোনো ফসলই চাষ করা যাবে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মিল লে-অফ ছিল। তখন দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে জমি ইজারা দেওয়া হয়। পরে মিল চালু হলে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে নিজেদের পক্ষে চাষাবাদ সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইজারা দিয়ে চাষাবাদ করা হয়েছে। চলতি বছর থেকেই খামার ইজারামুক্ত হয়েছে। কিন্তু এরপরই এখানে সাঁওতাল এবং কিছু মুসলিম ও হিন্দু বাসিন্দা ছাপরা ঘর তুলে বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই অধ্যাপক গত রোববার গোবিন্দগঞ্জে গিয়েছিলেন সাঁওতালদের অবস্থা দেখতে। ভূমির কাগজপত্র পরীক্ষা করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জমি যে সাঁওতালদের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাগদা ফার্ম বলে পরিচিত এ জায়গার নামকরণও হয়েছে সাঁওতাল নেতা বাগদা সরেনের নামে। কাগজে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই একটা চুক্তির মাধ্যমে চার মৌজার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (চিনিকলের) জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। চুক্তিপত্রের ৫ ধারায় বলা আছে, চিনিকল এবং আখ চাষের জন্য এই জমি নেওয়া হলো। যদি কখনো এ উদ্দেশ্য ছাড়া (আখ চাষ ছাড়া) অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জমি ব্যবহার করা হয়, তাহলে জমি সরকারের কাছে ফেরত দেওয়া হবে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষ দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে জমি ইজারা দেওয়ার যে কথা বলেছে, সে বিষয়ে অধ্যাপক বারকাত পাল্টা প্রশ্ন করেন, তাঁরা দরপত্রের কাগজ দেখাতে পারবেন? তিনি বলেন, জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে অনেকটা মৌখিকভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। কোনো গরিব বা জমির আদি মালিক আদিবাসীকে জমি ইজারা দেওয়া হয়নি।
গোবিন্দগঞ্জে গতকাল সরকারের দেওয়া ত্রাণ গ্রহণ করেন সাঁওতালপল্লির লোকজন। এর আগে গত সোমবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গেলে তাঁরা সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটি গতকাল মাদারপুর গ্রাম থেকে তোলা l প্রথম আলো

ত্রাণ নিল সাঁওতালরা
গত সোমবার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ ফিরিয়ে দিলেও গতকাল মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালরা সরকারি ত্রাণ নিয়েছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দুপুরে দুই গ্রামের ১৫০ পরিবারকে ২০ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, আধা কেজি ডাল, ১ কেজি আলু, ১ কেজি লবণ ও ২টি করে কম্বল দেওয়া হয়। দুপুরে মাদারপুর-সংলগ্ন ছোট জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনের সামনে এসব ত্রাণ বিতরণ করা হয়। মিশনারি অব চ্যারিটি নামের একটি দাতা সংস্থাও কাল ত্রাণ দিয়েছে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে মুঠোফোনে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সরকার সাঁওতালদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। তাই আমরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ত্রাণ নিয়েছি।’
স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা
সাঁওতালপল্লির শিশুরা ১০ দিন পর গতকাল থেকে স্কুলে যাচ্ছে। সাহেবগঞ্জ ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আবদুল বাকি জানালেন, তিনি নিজে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে শিশুদের স্কুলে নিয়ে এসেছেন। আবার ছুটির পর তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। বুজরুক বাড়িয়া আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুনুর রশিদও শিশুদের স্কুলে আসার কথা জানান।





 
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment