Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

চুক্তি অনুযায়ী জমি সাঁওতালরাই পাবে

লিমন বাসার, গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) থেকে
২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় ১৯৫৫-৫৬ সালে। পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন সেই জমিতেই চিনিকল প্রতিষ্ঠা করে। চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণের আগে ওই জমিতে বিস্তৃত জঙ্গল ছিল। তার মধ্যে সাঁওতাল ও বাঙালিদের ২০টিরও বেশি গ্রাম ছিল। জমি অধিগ্রহণের সময় সেখানকার অধিবাসীদের চিনির মিলে চাকরির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার। তারপর তাদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা জমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় চিনিকল।    
শুরুতে চিনিকলের জন্য পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের নিজস্ব জমির পরিমাণ ছিল ৭০ একর। চিনিকলের আখ চাষের জন্য আরো জমির দরকার হলে করপোরেশন জমি চেয়ে প্রাদেশিক সরকার বরাবর আবেদন করে। তার সঙ্গে তারা একটি পরিকল্পনাও জমা দেয়। তাতে উপজেলার সাহেবগঞ্জে পাঁচ মৌজায় (রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরহিমপুর) ১৮৪২.৩০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয় তারা। তাদের আবেদন মঞ্জুর করে সরকার। পরে আখের খামার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে পাঁচ মৌজায় (জে এল নম্বর ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১০ ও ১২০) ১৮৪২.৩০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ জারি করে সরকার। অধিগ্রহণের খরচ বাবদ অগ্রিম হিসেবে করপোরেশন তিন দফায় (১৯৫৫ সালের ১৯ মে, ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ও একই বছরের ৫ অক্টোবর) তৎকালীন রংপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর আট লাখ সাত হাজার ৩১৮ রুপি ১০ আনা ছয় পয়সা জমা দেয়। অধিগ্রহণ শেষে সেই জমি চিনিকল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়। তারপর সেখানে আখ চাষের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম। তবে অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কেউ কেউ তাও পায়নি। ফলে জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়। অধিগ্রহণ করা জমি চাষের হস্তান্তরের বিষয়ে ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের একটি চুক্তি হয়। তার ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, জমিগুলো শুধু রংপুর চিনিকলের আখ চাষের জন্যই ব্যবহৃত হবে। ওই জমিতে আখ চাষ না করা হলে ভবিষ্যতে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের জমি সরকারের (জেলা প্রশাসক) কাছে হস্তান্তর করবে এবং সরকার মালিকদের কাছে জমি ফিরিয়ে দেবে।

চুক্তির নথি, সাঁওতালদের কাছে থাকা পুরনো কাগজপত্র, সরকারি নথি ও বিভিন্ন সময় আইনজীবীদের দেওয়া আইনি মতামত (লিগ্যাল অপিনিয়ন) থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। নথির অনুলিপি কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। 
নথিপত্র অনুযায়ী, লোকসানের কারণে মাঝে দুই দফায় চিনিকলটি বন্ধ (লে অফ) করে দেওয়া হয়েছিল। পরে আবার চালু করা হয়। তবে নতুন করে চালু করা হলেও পরে আর পুরো জমিতে আখ চাষ হয়নি। বেশির ভাগ জমিই স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজনের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। গত বছর উপজেলা ভূমি অফিসের করা তদন্তের প্রতিবেদনে দেখা  যায়, ১৮৪২.৩০ একরের মধ্যে আবাদযোগ্য এক হাজার ৫০২ একর জমির পুরোটাই ইজারা দেওয়া হয়েছে। ইজারাদাররা এসব জমিতে আখের বদলে ধান, গম, তামাকসহ অন্যান্য ফসলের চাষ করছে।
সাঁওতালরা বলছে, চিনিকল কর্তৃপক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারা চুক্তি ভেঙে জমি ইজারা দিয়েছে এবং আখের বদলে সেখানে এখন অন্য ফসলের চাষ করা হচ্ছে। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় এখন সাঁওতালরা তাদের জমি ফেরত চাইছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৪০ সালের আরএস রেকর্ড অনুযায়ী, ওই জমির মালিক মূলত সাঁওতালরা। তাদের সঙ্গে কোল, ওঁরাও জনগোষ্ঠী এবং কিছু বাঙালিরও জমি আছে। ১৯৬২ সালে জমির যে সীমানা নির্ধারণ (ডিমারকেশন) করা হয়, সেখানেও বলা আছে, কোন জমি কার। ওই পাঁচ মৌজার জমির মালিকদের অধিকাংশের নামই সরেন, টুডু, মুণ্ডা ইত্যাদি। তাঁরা এখন যাঁরা জমির মালিকানা দাবি করছেন তাঁদেরই পূর্বপুরুষ। অধিগ্রহণের প্রায় ৪০ বছর পর একবার ২০০২ সালে, আরেকবার ২০০৪ সালে চিনিকলটি সাময়িক বন্ধ (লে অফ) ঘোষণা করা হয়। এরপর সেখানে আখ চাষ বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে জমিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে-বেনামে বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দরে ইজারা দিয়েছে। সেখানে তারা আখের পরিবর্তে ধান, তামাক, মিষ্টি কুমড়া, সরিষা, আলুসহ অন্যান্য মৌসুমি ফসলের আবাদ শুরু করে। সে হিসেবে চিনিকল কর্তৃপক্ষ গত ১২ বছরে চুক্তিবহির্ভূতভাবে সাড়ে চার হাজার বিঘা জমি ইজারা দেয়। এ সময়ে বিঘাপ্রতি গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরে হিসাব করলেও শত কোটি টাকার ওপরে আদায় করেছে তারা। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, চুক্তির শর্ত অনুসারে ওই জমি তাঁদের। চুক্তি ভঙ্গ করে মিল কর্তৃপক্ষ জমি ইজারার মাধ্যমে যে টাকা আদায় করেছে, সে টাকার মালিকও সাঁওতালরাই।
গাইবান্ধা ও রংপুর জেলা প্রশাসন এবং ভূমি অফিসের পুরনো রেকর্ডপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, সে সময় পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের বিভাগীয় অফিস ছিল গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ। গাইবান্ধা তখন ছিল মহকুমা। ১৯৬২ সালের চুক্তিপত্রের আগে সরকারের কাছে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ওই এলাকায় আখের ফার্ম স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। তারা ১৯৪৮ সালের রিকুইজেশন অব প্রোপারটি অ্যাক্ট অনুযায়ী ওই ১৮৪২.৩০ একর জমি হুকুম দখলের জন্য পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়।
১৯৬২ সালের চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে বাণিজ্যিক উন্নয়নে প্রাদেশিক শিল্প-কারখানার জন্য আইন অনুযায়ী জমি হুকুম দখল করা হয়েছে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে বা কারো আপত্তি থাকলে চুক্তির ৫ নম্বর ধারামতে তদন্ত হবে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ আপত্তি দিতে পারবে।
চুক্তিতে ধারা আছে সাতটি। ৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, জমি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে প্রাদেশিক সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় যদি ধরা পড়ে যে অ্যাকুইজিশন (ফরমায়েশ) হয়েছে প্রকৃত উদ্দেশ্যে বিপরীতে, তাহলে করপোরেশন ওই সম্পত্তি প্রাদেশিক সরকার বরাবর ফেরত দেবে। এর মাধ্যমে জমি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। অর্থাৎ করপোরেশন জমি সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে এবং সরকার তা মালিকদের কাছে ফেরত দেবে।
১৯৪৮ সালের রিকুইজিশন অব প্রোপার্টি অ্যাক্টের ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সম্পত্তি পুনরায় সরকারের কাছে হস্তান্তর ও তা মূল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় যে খরচ হবে তা দেবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও দেবে তারা। 
আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন কালের কণ্ঠকে বলেন, জমি সাঁওতালদেরই। ওই চুক্তির শর্ত অনুসারে সাঁওতালরা যে ক্ষতিপূরণসহ জমি ফেরত পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কয়েক শ কোটি টাকা মূল্যমানের জমিটি বেহাত করতে এখন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা নানা ষড়যন্ত্র করছে। যার ধারাবাহিকতায় গত ৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মে সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে নৃশংস হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে। প্রশাসনের একটি মহলও ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে। যে কারণে জমির মূল দলিলপত্র সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী প্রধান বলেন, ‘এ জমি চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উদ্ধার করে রেস্টোরেশনের মাধ্যমে ভূমিহারা কৃষকদের (আদিবাসী) কাছে ফেরত দিতে গত বছরের ১৫ মার্চ গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে, সব পক্ষের বক্তব্য শুনে মিল কর্তৃপক্ষের চুক্তি ভঙ্গের বিষয়ে আমাদের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। কিন্তু তার পরও এখন পর্যন্ত জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উল্টো জমি ফেরত চাইলেই প্রাণভয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহজাহান আলী প্রধানের আবেদনের পর ২০১৫ সালের ২১ জুন গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব্ব) গোপনীয় শাখা একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তিন পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে (স্মারক নং ০৫.৫৫.৩২০০.০৩০.০০.০০১.১৫-৪১) সই করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলেয়া খাতুন (উপসচিব)। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আবেদন পাওয়ার পর স্বাক্ষরকারী নিজে (আলেয়া খাতুন) ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ অভিযোগের তদন্ত করতে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে যান। এ সময় তাঁর সঙ্গে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সার্ভেয়ার উপস্থিত ছিলেন। একই সঙ্গে রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার ও অভিযোগকারী (শাহজাহান আলী প্রধান) উপস্থিত ছিলেন। তদন্তকালে দেখা গেছে, উল্লিখিত জমিতে ধান, সরিষা, আলু, মিষ্টি কুমড়া, তামাকের আবাদ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উভয় পক্ষের অভিযোগ ও ব্যাখ্যার কথাও উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে মতামত অংশে বলা হয়েছ, ‘রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, আবেদনকারীর বক্তব্য এবং দাখিলকৃত কাগজপত্রাদি ইত্যাদি পর্যালোচনায় আবেদনকারীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।’      
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি আদিবাসী নেতা ফিলিমন বাস্কে বলেন, কমিটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন ছাড়াও সম্পত্তি নিয়ে ভূমিহারা কৃষকদের অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নালিশি সম্পত্তি যাতে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে ফের ইজারা দিতে না পারে সে জন্যও আবেদন করা হয়েছিল। সে বিষয়টিরও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।
ইজারার পুনঃটেন্ডার বা যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিস সরেজমিন তদন্ত করে। তদন্তের নথি (স্মারক নং উঃভঃঅঃ/গোবিন্দ/২০১৫-৬১১, তারিখ : ২১/০৩/২০১৫ এবং ৩১.৫৫.৩২০০০.০৩১০৬.০১২.১৫-৪৬০, তারিখ ০৯/০৪/২০১৫) অনুযায়ী, ১৮৪২.৩০ একর জমির মধ্যে আবাদযোগ্য ১৫০২ একরের পুরোটাই পর্যায়ক্রমে ইজারা দিয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৯ মাসের জন্য এসব জমি ইজারা দেওয়া হয়। বাকি প্রায় ৩৪০ একর জমি স্টাফ কোয়ার্টার, রাস্তাঘাট ও পুকুর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইজারা দেওয়া জমিতে ধান, গম পাট ও তামাক ছাড়াও নানা সবজি চাষ করা হচ্ছে। মিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরবর্তী মৌসুমে তারা প্রায় ৭৫৮ একর জমিতে আখ চাষের পরিকল্পনা নিয়েছে। 
রংপুর চিনিকলের একটি সূত্র জানায়, চিনিকলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শিল্প ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে ২০০৪ সালে মিলটি লে অফ ঘোষণা করা হয়। পরে ২০০৬ সালে মিলটি ফের চালু করা হয়। এর পর থেকেই মিলের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে উল্লিখিত জমিতে আখ চাষের পরিবর্তে ইজারার মাধ্যমে ধান, গম, ভুট্টা, আলু, লাউ, কুমড়া ও তামাক চাষ করা হয়। এর কারণেই সুগার মিলের চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় অংশীদার সূত্রে জমির মূল মালিকরা সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি গঠন করে প্রায় তিন বছর ধরে জমি উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত গত সপ্তাহে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চল ঘুরে এসেছেন। সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জমি যে সাঁওতালদের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দোলনরত সাঁওতালদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন, চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০০২ সালের দিকে তাঁরা (সাঁওতালরা) আন্দোলন শুরু করেন। ২০১৪ সালে জমি উদ্ধার কমিটি করা হয়। নাম দেওয়া হয় সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম জমি উদ্ধার কমিটি। জমি যে সাঁওতালদেরই এর আরেকটি প্রমাণ হলো বাগদা ফার্ম বলে যে জায়গাটির নাম, তা হয়েছে বাগদা নামের এক সাঁওতাল আদিবাসীর নামে। সাঁওতালরা তাঁকে জানিয়েছেন এ জমি তাঁদের বাপ-দাদার। তাঁরা সেগুলো ফেরত চান।
আবুল বারকাত আরো বলেন, ১৯৬২ সালে এখান থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর জমির মালিকদের অনেকে অন্যত্র ঠাঁই নেন। রাজশাহী, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁরা বাস করতে শুরু করেন। জমি ফেরত পাওয়ার প্রসঙ্গ আসায় সেই মানুষগুলো এখানে আসছেন। এখন আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁরা প্রাণভয়ে পালিয়ে রয়েছেন। আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মোট জমির ১০ ভাগের মতো অংশে এখন আখ চাষ হচ্ছে। তবে সেটা রংপুর সুগার মিলের জন্য নয়, জয়পুরহাট সুগার মিলের জন্য। রংপুর সুগার মিল এখন বন্ধ রয়েছে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, চিনিকলের ওই জমি অধিগ্রহণ নয়, বরং ১৯৪৮ সালের রিকুইজিশন অব প্রোপার্টি অ্যাক্ট অনুযায়ী তা হুকুম দখল করা হয়েছে। হুকুম দখল হয় একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং তাতে শর্ত দেওয়া থাকে যে জমির চরিত্র কোনোভাবেই বদলানো যাবে না। কখনো যদি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হয় তাহলে সরকার জমিটি ফেরত নেবে। এরপর জেলা প্রশাসক নিজ উদ্যোগে জমির বৈধ দাবিদারকে শনাক্ত করে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জমি হস্তান্তর করবে।     
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব! : আখ চাষ হবে বলে সম্প্রতি সাঁওতালদের বসতি তুলে দিয়ে পুরো জমি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। অথচ গত ১৫ মে চিনিকলের ১৮৪২.৩০ একর জমি অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত দেখিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ এ প্রস্তাব পাঠান (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১৪ অক্টোবর ২০১৫ তারিখের ০৪.০০.০০০০.৫১৪.০৬.০০৫.২০১৫-৪১০ নং স্মারক)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ প্রস্তাব পাঠানোর কথা স্বীকার করেন। তবে প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
জমির বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সাঁওতালরা কেউ আমার কাছে আসেনি। না এলে আমি তো এগিয়ে যাব না। আর জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা নিষ্পত্তি হবে আদালতে। এখানে জেলা প্রশাসনের কিছু করার নেই।’
জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুস সামাদ বলেন, অধিগ্রহণ বিষয়ে ১৯৮৪ সালে একটি আইন হয়েছে। পরে ১৯৯৮ সালে সেটি সংশোধন করা হয়েছে। এ আইন অনুসারে অধিগ্রহণ করা জমি আগের মালিকদের ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তবে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, চিনিকলের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে পাকিস্তান আমলে, এ নিয়ে চুক্তি হয়েছে ১৯৬২ সালে। পুরনো আইনে যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলোর চুক্তির শর্ত তো আর বাতিল হয়ে যাবে না।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2016/11/20/431194





Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment