২০১৫-০৬-৩০ ১২:০৮:৩৯ এএম
রিজভী জয় : আজ ৩০ জুন। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা
সাঁওতাল ‘হুল’ দিবস। প্রচলিত ইতিহাস চর্চায় অধিপতিশীল জ্ঞানকাঠামো এ
বিদ্রোহের প্রাপ্য স্বীকৃতি না দিলেও ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও
মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিন এটি।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘটিত
প্রতিবাদ। ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের এ এক অতুলনীয় অধ্যায়। যে প্রকার
শাসন, শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে পরাধীন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সৃষ্টি হয় ১৮৫৫
সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ সে ধরনের শোষণ অত্যাচারেরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
১৮৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত এ বিদ্রোহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিহার, উড়িষ্যা এবং
বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহের তীব্রতা ও ভয়াবহতায়
ইংরেজ শাসনের ভীত কেঁপে উঠেছিল। লর্ড ডালহৌসি কতৃক মার্শাল ল’ জারি করেও এ
বিদ্রোহ দমান করা যায়নি।
অসম যুদ্ধের ফলস্বরূপ, এ বিদ্রোহে সাঁওতালদের পরাজয় ঘটলেও, বৈদেশিক শাসন
এবং দেশিও সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণের মূলৎপাটন করার লক্ষ্যে পরিচালিত এ
বিদ্রোহ ভারতবর্ষের মানুষের মনে যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা জাগ্রত
করেছিল, সে চেতনার আলোতেই উদিত হয়েছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য।
অথচ সাঁওতাল বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ আজও আসেনি পাদপ্রদীপের আলোয়।
নিষাদ জাতির অন্তর্ভুক্ত সাঁওতালদের আদি বাসভূমি যে ভারতবর্ষ তাতে
নৃবিজ্ঞানীরা সন্দেহ পোষণ করেননি। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, পাকুর,
পূর্ণিয়া অঞ্চলে অবস্থান করলেও, সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল বাস করে ভাগলপুরের
দামিন-ই-কোতে। বহু কষ্ট করে বন সাফ করে শ্বাপদ-সংকুল দামিন-ই-কোতে তারা
জনপদ গড়ে তুলেছিল।অতীতে যে মাটিতে মানব বিচরণই ছিল না সে মাটিতে ফলিয়েছিল
সোনালী ফসল।নিজেদের আলাদা একটা জগত তৈরি করেছিল তারা। যেখানে ছিল না কোনো
মহাজন-জমিদার-দালাল, ছিল না কোনো ঋণগ্রস্ত কেউ।
দামিন-ই-কো’র সমৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে সেখানে আগমন ঘটে ব্যবসায়ী
ও মহাজন শ্রেণির। তারা ব্যবসার নামে বিনিময়ের সময় সহজ সরল সাঁওতালদের
চরমভাবে ঠকানো শুরু করল। কিছু চাল, কিছু অর্থ বা অন্য দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত
জীবনের জন্য সাঁওতালদের ভাগ্যবিধাতা ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসল মহাজনরা।
ফলে পাথুরে জমিতে সাঁওতালদের অশেষ পরিশ্রমে ফলানো ফসল, যা তারা প্রাণ
দিয়ে রক্ষা করতো, বন্য হাতি, শূকর ও অন্যান্য জীবজন্তুর হাত থেকে, তা তুলে
দিত মহাজনের হাতে। তবু শোধ হতো না ঋণ। কোন চাষী মহাজনের হাতে ফসল তুলে দিতে
অস্বীকার করলে, মহাজনেরা দেওঘর বা ভাগলপুর আদালতে ঘুষ দিয়ে আনত ক্রোকি
পরোয়ানা। আদালতের পেয়াদার উপস্থিতিতে তখন নিজের সর্বনাশ দেখা ছাড়া অন্য
কোনো উপায় থাকতো না সাঁওতালদের।
ঋণ দেয়ার সময় মহাজনরা যত টাকা দিত, লিখিয়ে নিত তার চেয়ে অনেক বেশি। এবং
ঋণ শোধের সময় সুদসমেত আসল টাকা আলাদা আলাদা দিতে হতো। ফলে সব দিয়েও অনেক
সময় শোধ হতো না মহাজনের ঋণ। তখন সাঁওতাল চাষি বাধ্য হতো নিজেকে বন্ধক দিতে
এবং মহাজনের ক্রীতদাসে পরিণত হতে। বিনা পারিশ্রমিকে খাটতে খাটতে তার জীবন
শেষ হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, পরবর্তী বংশধরের জন্য সে একটা জিনিসই রেখে যেতে
পারত, তা হলো মহাজনের ঋণ। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ইংরেজদের খাজনা। সাঁওতালদের
চাষকৃত জমির উপরে ইংরেজদের নির্ধারিত খজনা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেতে
লাগল অবিশ্বাস্যভাবে। ১৮৩৮ সালে যেখানে মোট খাজনা আদায় হয়েছিল ২০০০ টাকা,
সেখানে ১৮৫১ সালে আদায় করা হলো ৪৩,৯১৮ টাকা ১৩ আনা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো
স্থানীয় জমিদারদের লোলুপ দৃষ্টি। সাঁওতালদের জমি গ্রাস করার বিভিন্ন উপায়
খুঁজত তারা। এই উদ্দেশে তারা তাদের গরু, ছাগল, মহিষ, টাট্টু ঘোড়া এমনকি
হাতির বাঁধন খুলে দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে দরিদ্র সাঁওতালদের ক্ষেতের পাকা ফসল
নষ্ট করে ফেলত।
এই অমানবিকতার প্রতিকার সাঁওতালদের হাতে ছিল না। ইংরেজদের বিচারালয়
তাদের নাগালের বাইরে ছিল। তাছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ
থেকে ন্যায় বিচার পাবার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ঐতিহাসিক কে কে দত্ত তার
‘দি সান্তাল ইন্সারেকশান’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-
‘দুর্নীতিগ্রস্ত
কোর্টের আমলা, মোক্তার, পিওন ও বরকন্দাজদের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাওয়ার
কোনো সম্ভাবনা ছিল না। যদিও মাঝে মাঝে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে
ন্যায়বিচারের দেখা মিলত, কিন্তু ভয়ে সাঁওতালরা সেখান থেকে দূরেই থাকতো।
বাড়ির কাছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনস্ত দারোগা বা থানা পুলিশের ন্যায়
বিচারের যে রূপ তারা দেখতে পেত তা মৃত্যুরই নামান্তর।’
কাজেই আদালতে সুবিচার লাভ সাঁওতালদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।নিপীড়ন
নিষ্পেষণের জালে আটকে যাওয়া এই সহজ সরল মানুষগুলোর আদতে মুক্তির কোনো পথ
খোলা ছিল না।ফলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাস্বরূপ তারা বিদ্রোহে অংশ
নেয়। ১৮৫৪ সালের শেষে আর ১৮৫৫ সালের শুরুতে সাঁওতালরা একটি সম্মিলিত
সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা হিন্দু মহাজনদের আর লাভের বখরা নিতে দেবে না। গরিব
দিনমুজুর সাঁওতালরা ঠিক করেছিল তারা আর ক্রীতদাসত্ব করবে না। এইরূপ
অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে বিশেষত মানুষ যখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে, তখন নেতার
অভাব হয় না। সেই সময় শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদের মধ্য থেকেই
ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হন বিদ্রোহের নায়ক, নিষ্কলুশ চরিত্রের চার ভাই
সিদু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। তারা সাঁওতালদের বিদ্রোহের জন্য অনুপ্রাণিত ও
সংগঠিত করেন।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। ভাগনদিহিতে চারশ গ্রামের দশ হাজার সাঁওতাল এক
সমাবেশে উপস্থিত হয়। সিদু সমাবেশে ইংরেজ ও জমিদার মহাজন কর্তৃক তাদের ওপর
নির্মম নিপীড়নের করুণ কাহিনি তুলে ধরে বক্তব্য দেন।সমগ্র জনসভা এ সময়
বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণিকে উৎখাত করে স্বাধীন সাঁওতাল
রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেয় তারা সমাবেশ থেকে। এই সমাবেশ থেকেই ইংরেজ সরকার,
কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করা হয়।
দারোগা ও জমিদারদের নিকট ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দাবি করা হয়।এক পর্যায়ে প্রায়
৫০ হাজার সাঁওতালের এক বিশাল মিছিল বড়লাটের কাছে অভিযোগ পেশ করার
উদ্দেশ্যে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। এ অভিযানে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয়
অন্যান্য ধর্মের শোষিত, নিপীড়িত মানুষ।
সাঁওতালদের এ সমবেত অভিযাত্রার কথা শুনে শোষক শ্রেণির মহাজন জমিদাররা
ভীত হয়ে পড়ে। তারা দারোগা মহেশলাল দত্তকে ঘুষ দিয়ে সিদু, কানুকে গ্রেফতার
করার জন্য প্ররোচিত করে। দারোগা সিদু ও কানুকে চুরি ডাকাতির অভিযোগে
গ্রেফতার করতে গেলে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা বাঁধা দেয়।দারোগা জোরপূর্বক সিদু,
কানুকে গ্রেফতার করতে চাইলে বিদ্রোহীরা সেখানেই মহেশলাল দত্ত, মহাজন মানিক
মুদিসহ ১৯ জনকে হত্যা করে। কানু ঘোষণা দেন, ‘বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, এখন আর
কোনো হাকিম নেই, ইংরেজ নেই, সরকার নেই। সাঁওতালদের রাজত্ব এসে গেছে।’
বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা বহু থানা, ইংরেজ সৈন্যদের ঘাটি, নীলকরদের কুঠি
আক্রমণ ও ভস্মীভূত করে। সমগ্র বিহার, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ
অঞ্চলে সাঁওতালদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ সরকার এ আকস্মিক বিদ্রোহের
প্রচণ্ডতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। অবশেষে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে ১৫ হাজার
সৈন্য, অশ্বারোহী বাহিনী, কামান বাহিনী ও হস্তী বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ
দমনের অভিযান চালানো হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রচণ্ড
বর্বরতায় উন্মত্ত হাতি ছেড়ে দেয়া হয় সাঁওতাল নারী ও শিশুদের মধ্যে।কামান ও
বন্দুকের সামনে টিকতে না পেরে বিদ্রোহীরা গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য
হয়।
এভাবে ৩০ হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে ইংরেজ
বাহিনী। ভাগলপুরে এক ভয়াবহ বন্দুক যুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক
চাঁদ ও ভৈরব নিহত হন। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ বাহিনী সিদুকে ধরে
ফেলে সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করে। কানু বীরভূম জেলায় একদল পুলিশ কর্তৃক ধৃত হলে
তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়।পরাধীন শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের সাঁওতাল
বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিদু, কানু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন
বিসর্জন দিয়ে গেছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহ নিপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের চিরদিনের প্রেরণার উৎস। এ
সংগ্রামে পরাজয় ছিল কিন্তু আপোষ ছিল না। বিদ্রোহীরা নির্ভয়ে মৃত্যুকে
আলিঙ্গন করেছে কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের
কাহিনি প্রেরণা যুগিয়েছে ভারতবর্ষের পরবর্তী সকল স্বাধীকার আন্দোলনে।
ফাঁসির মঞ্চে কানুর দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল, ‘আমি আবার ফিরে আসব, সারা দেশে
বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’। তার এ কথা সত্য হয়েছে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা
সূর্য সেনদের আত্মত্যাগে। সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রমাণ করে দিয়েছে মুক্তির
সংগ্রাম কোনো দিন শেষ হয়ে যায় না। মানুষ পৃথিবীতে যতদিন থাকবে শোষণ মুক্তির
সংগ্রাম চলবে ততদিন।
সাঁওতাল বিদ্রোহের পর কেটে গেছে ১৬০ বছর। মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়ালেও
বদলায়নি সাঁওতালদের ভাগ্য। তারা থেকে গেছে শোষিতের কাতারে। কালে কালে শুধু
বদলেছে শোষকের পরিচয়। আজও অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামাজিক শোষণ, বঞ্চনা ও
অস্পৃশ্যতার শিকার এ দেশের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নানা সমস্যায়
জর্জরিত তারা। জমি বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল, জাতিগত বৈষম্য,
হয়রানি ইত্যাদি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। তাদের অস্তিত্ব
আজ সঙ্কটাপন্ন, ভাষা বিপন্ন। তাদের উন্নয়নের জন্য অদ্যাবধি তেমন আন্তরিক ও
জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তারা কী ধরনের উন্নয়ন চায় সে ব্যাপারে
তাদের অভিমত শোনার প্রয়োজন কখনো বোধ করেনি কেউ। নিজের দেশেই, এই স্বাধীন
মাটিতেই তারা চরম অবহেলার শিকার হয়ে আজো বেঁচে আছে।
অধিপতিশীল জ্ঞানকাঠামোয় সিদু, কানুদের আত্মত্যাগের ইতিহাস সেভাবে
উচ্চারিত হয় না। তাতে কি আসে যায়, জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যু
সেখানে শেষ কথা নয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর শহীদদের লাল সালাম।
http://www.risingbd.com/travel-news/113897
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment