অদম্য ইচ্ছা থাকলে নিজের কর্ম আর প্রচেষ্টার জয় হয়-ই একদিন। আর এই জয়ী হওয়ার গল্পই পরে অন্য অনেকের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। এমনি অনুপ্রেরণার দুই নাম খাগড়াছড়ির চাঁদনী সাঁওতাল ও তার মা সুমি সাঁওতাল। মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়েকে শিক্ষিত করার। তবে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অর্থের, সে বাধাকে আরও জোরালো করেছিল বাবার নিরুদ্দেশ হওয়া। তবে এত প্রতিকূলতাও দমাতে পারেনি মাকে। নিজে দিনমজুরি করে মেয়েকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর। আর মায়ের সাহস বুকে ধারণ করে আলোকিত হওয়ার পথে আরও এগিয়ে যাচ্ছেন একমাত্র মেয়ে চাঁদনী সাঁওতাল।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী সাঁওতালদের বসবাস মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায়। পাহাড়েও যে তাদের বসবাস আছে, সেটি হয়তো অনেকেরই অজানা। তাই পাহাড়ের সাঁওতালদের বঞ্চনার ইতিহাস অজানা থাকাটাও স্বাভাবিক। সেই বঞ্চনার প্রাচীর ভেঙেই প্রথম সরকারি চাকরি পান জেলার পানছড়ি উপজেলার চাঁদনী সাঁওতাল। দুই বছর বয়সে তার বাবা সুনীল সাঁওতাল নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সেই থেকে দাদার বাড়িতে মা সুমি সাঁওতালই তাকে মানুষ করেছেন। বর্তমানে তিনি পানছড়ির গোলক প্রতিমামুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পাশাপাশি খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ইতিহাস অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন।
১৯৯৫ সালে পানছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের সাঁওতালপাড়ায় চাঁদনীর জন্ম। নিজেদের বাড়ি-ভিটে কিছুই নেই। চাঁদনী বলেন, মানুষের বাড়ি-জমিতে কাজ করে মা-ই এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার সাহস জুগিয়েছেন।
২০০৩ সালে নন্দু চাকমা নামে এক শিক্ষকের সহযোগিতায় চাঁদনীর ঠাঁই হয় খাগড়াছড়ি জেলা শহরের সরকারি শিশু সদনে। এখান থেকেই একমাত্র সাঁওতাল শিক্ষার্থী হিসেবে ২০১১ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। এর আগে খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলার সাঁওতালদের কোনো ছেলে বা মেয়ে এসএসসি পাস করতে পারেনি। সাঁওতালরা পদবিতে সাঁওতাল শব্দটি ব্যবহার করে না। তবে পাহাড়ে বসবাসরত চাঁদনীর মতো অনেকেই পদবি হিসেবে সাঁওতাল লিখছেন।
চাঁদনীর মা বলেন, একসময় অনেক জমিজমা ছিল। শিক্ষার অভাবে সব বেহাত-বেদখল হয়েছে। দু'বেলা ভাতের জন্য নিজেদের জমিতেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। তাই জেদ ছিল, শত কষ্ট হলেও মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করব, যাতে সমাজে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই আশা বুকে নিয়েই দূরপানে চেয়ে আছি।
চাঁদনী বলেন, বাড়িতে এসে মায়ের মুখটা দেখলে কেন জানি বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হতো। আমার জন্য মা এখনও দিনমজুরি করেন। এটা ভাবতে গেলেই জীবনটাকে অসহনীয় মনে হতে থাকে। তবে মেয়ের উদ্দেশে মায়ের একটাই কথা- 'তোমাকে শিক্ষার সর্বোচ্চ জায়গায় দেখতে চাই।' চাঁদনী বলেন, বুকে মায়ের সাহস নিয়ে এখনও এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি জানান, একটি প্রকল্পে কাজের সূত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে।
গত বছর থেকে গোলক প্রতিমামুখ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত চাঁদনী নিজের সম্প্রদায়ের শিশুদের ঝরে পড়া রোধ, স্কুলমুখী করাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছেন। চাঁদনী বলেন, 'জীবনে এতটুকু আসার পেছনে মায়ের পাশাপাশি নন্দু চাকমা স্যার, পানছড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা, অগ্রজ মানিক সাঁওতাল এবং স্থানীয় শিক্ষক বিজয় কুমার দেবের অবদান স্মরণীয়।'
http://samakal.com/…/%E0%A6%85%E0%A6%A6%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E…
http://samakal.com/…/%E0%A6%85%E0%A6%A6%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E…
0 comments:
Post a Comment