Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

আমার বর্ণমালা, দুঃখিনী বর্ণমালা

মোস্তাফা জব্বার
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাত বারোটা চার মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের বাংলা ভাষা সংক্রান্ত নবীনতম প্রকল্প ডিজিটাল হরফ বানানোর তৃতীয় প্রচেষ্টা 'আমার বর্ণমালা'র উদ্বোধন করলেন। তার কিছুটা আগে এই প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন সরকারি কর্মকর্তা বিটিভির সরাসরি সম্প্রচারে জানালেন, প্রমিত বাংলা বর্ণমালা হিসেবে এই ফন্ট তৈরি করা হয়েছে। ইউনিকোডভিত্তিক এই বর্ণমালা বাংলা লেখার যুক্তাক্ষর সমস্যার সমাধান করবে এবং ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে সহায়তা করবে বলে তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন। তিনি সেই সময় আরও জানান যে, একটি প্রমিত কীবোর্ড তৈরির কাজও সরকার করছে। বর্ণমালাটি উদ্বোধনের পরপরই আমি এর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে অনেক চেষ্টা করেও ফন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। কিছু সময় পর ওয়েবসাইটটিই গায়েব হয়ে গেল। ওখানে আর প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত আরও কিছুটা সময় লাগবে প্রকাশিত ফন্টগুলো পেতে। তবে আমাকে বিস্মিত করে ওয়েবসাইটটি দেখালো যে, ওখানে দেখানো ফন্টটি নতুন তৈরি করা ফন্টতো নয়ই, বরং মাইক্রোসফট উইন্ডোজের সাথে প্রদত্ত বৃন্দা ফন্ট। কেন যে ওয়েবসাইটটি নতুন ফন্টে গড়ে উঠলো না সেটি আমার ধারণার বাইরে।

কয়েকমাস আগে আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় খবর দেখেছিলাম যে, বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক্স বিভাগ এবং সরকারের এটুআই নামক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান 'আমার বর্ণমালা' নামে একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তখন এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রধানমন্ত্রী এই ফন্টটি উদ্বোধন করবেন সেরকম একটি ঘোষণাও আমরা এই খবরের সাথে দেখেছিলাম। তখন এটিও বলা হয়েছিল যে, এটি নাকি সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা হরফ তৈরির প্রথম উদ্যোগ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৩ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলা একাডেমী ও এটুআই জানিয়েছে যে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী ২টি ফন্ট উদ্বোধন করবেন। ফন্ট ২টির নাম হচ্ছে শাপলা ও দোয়েল। আরও একটি ফন্ট নাকি আগামী বৈশাখের আগেই প্রস্তুত হয়ে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের নাইমা হক ও মাকসুদ সাহেব ফন্টটির জন্য কাজ করছেন বলে তখন জানানো হয়।

সরকারের প্রথম বাংলা ফন্ট: ইতিহাসের সত্য উপস্থাপনের জন্যই এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করা দরকার। বিশেষ করে সরকারের প্রথম উদ্যোগ এটি কিনা বা এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করা অবশ্যই জরুরি। আমরা যদি একটু অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে যন্ত্রে বাংলা হরফের জন্ম হচ্ছে ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হলহেডের ব্যাকরণ বইয়ের মাধ্যমে। তখন উইলকিনস নামক একজন ইংরেজ বাংলা হরফের ডিজাইন তৈরি করেন এবং পঞ্চানন কর্মকার নামক এক বাঙ্গাল ছেনি কেটে সিসা দিয়ে বাংলা হরফ তৈরি করেন। এই হরফমালার প্রযুক্তিগত বির্বতনের মধ্যে তিনটি বড় পরিবর্তনের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। শেষ পরিবর্তনটি বাংলা হরফের ডিজিটাল যাত্রার। এর সূচনা হয় ফটোটাইপসেটার দিয়ে। অন্যদিকে অফিস-আদালতে ব্যবহার করতে টাইপরাইটারের জন্য বাংলা হরফ তৈরি হয়। তবে বিগত শতকের আশির দশক পর্যন্ত প্রায় একশো বছর জুড়ে মেটাল হরফই ছিল একমাত্র অবলম্বন। বাংলাদেশের বহুল ব্যবহূত টাইপরাইটার হচ্ছে অপটিমা মুনীর আর ফটোকম্পোজ যন্ত্র হিসেবে এক সময় অনেক জনপ্রিয় ছিল লাইনোটাইপ। মনোটাইপ, ভেরিটাইপার নামক প্রতিষ্ঠানসমূহও যুক্ত ছিল এই বিবর্তনের সাথে। তবে বাংলা হরফের আজকের যে পর্যায় সে পর্যায়টি হচ্ছে কম্পিউটারনির্ভর এবং এটি আমি খুব সবিনয়ে বলতে পারি যে, এই হরফমালা তৈরি করার প্রক্রিয়ার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক পঁচিশ বছরের বেশি সময়ের। তবে আমার আগেও বিগত শতকের আশির দশকের শুরুতে কম্পিউটারের জন্য বাংলা হরফ তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয়। বাংলা হরফকে কম্পিউটারের পর্দায় দেখানোর জন্য প্রথম সফল প্রচেষ্টা ছিল সাইফুদ্দাহার শহীদের। তবে মুদ্রণ এবং প্রকাশনা অর্থাত্ পেশাদারি কাজে ব্যবহারের জন্য আমরা বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের জন্য যে ফন্টগুলো তৈরি করেছিলাম—আনন্দ, সুনন্দা, সুতন্বী; সেগুলো এই পঁচিশ বছর যাবত্ অত্যন্ত জনপ্রিয় ফন্ট হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। এর বাইরেও সরকার অন্তত আরও দুইবার দুইটি ফন্ট তৈরি করেছে। খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জেগেছে যে, আবার নতুন করে একটি ফন্ট তৈরির প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল।

আমরা যদি একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি করার সিদ্বান্ত নেয়া হয় তখন নির্বাচন কমিশন ইউএনডিপির সহায়তায় কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে। ইউএনডিপি নির্বাচন কমিশনকে কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার দিয়ে সহায়তা করে এবং খুব সঙ্গত কারণে এটা দ্বারা বাংলা লেখার সফটওয়্যার নিয়েও মাথা ঘামায়। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সেই সময় বাংলা লেখার সফটওয়্যার হিসেবে তারা চেষ্টা করেছে, যাতে প্রচলিত বিজয় বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহার না করা যায়। এমনকি যদিও বিজয় কীবোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে তবুও সেটিকে বিজয়ের নামে পরিচিত করানো হয়নি। বরং একে যে সফটওয়্যারে বিনা অনুমতিতে যুক্ত করা হয়েছিল তার প্রতি তত্কালীন সরকার এবং ইউএনডিপি সহায়তা করে। সেই পাইরেটেড সংস্করণটি নিয়ে এখনও উভয় মহলে প্রচণ্ড উত্সাহ রয়েছে। তারা এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এ সম্পর্কে আমি অনেক আগেই বলেছি যে, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক এই ধরনের পাইরেসিকে উত্সাহিত করা মোটেও ভালো কাজ হয়নি। পরবর্তীকালে ইউএনডিপি এবং এটুআই একসাথে মিলে নির্বাচন কমিশনের জন্য আরেকটু সহযোগিতামূলক কাজ করার চেষ্টা করে এবং তারা নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সংক্ষেপে নিকস নামে একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করে। বিস্ময়কর যে, এটুআই সেই ফন্টটির কথা ভুলে গিয়েই এখন বলছে যে, বাংলা একাডেমীর সাথে মিলে প্রথম ফন্ট তৈরি করছে। জেনে রাখা ভালো যে, আমাদের মুদ্রণ এবং প্রকাশনায় যে ফন্ট ব্যবহার করা হয় সে ফন্টগুলোর যে কোডিং এবং নির্বাচন কমিশন যে কোড ব্যবহার করে তার মধ্যে পার্থক্য আছে। নির্বাচন কমিশন ইউনিকোডকে মান হিসেবে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের মান আসলেই ইউনিকোডের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা। কিন্তু সে সময়ও যখন নির্বাচন কমিশন এই ফন্ট বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে তখনও আমাদের ৭৫টি ইউনিকোড ফন্ট ছিল। এর বাইরে এ্যাপল কম্পিউটার, মাইক্রোসফট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও ইউনিকোডভিত্তিক ফন্ট রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ইউনিকোডের ব্যবহার সীমিত রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের সুতন্বীর চাইতে ভালো ডিজিটাল ফন্ট এখনও বাংলায় তৈরি হয়নি। আমাদের বাইরেও বিনামূল্যের অথবা ইন্টারনেটে পাওয়া যায় এমন আরো ডজনখানেক ফন্ট অন্তত রয়েছে। একবার যখন নিকস ফন্ট তৈরি হয় তখন তারা আমিসহ আরও কয়েকজনকে মতামত দিতে ডেকেছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই সভায় যোগ দেবার। আমরা ফন্টটা দেখেছিলাম এবং তাকে অপেশাদারি বলে মতামত দিয়েছিলাম। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনারা পণ্ডশ্রম কেন করতে যাচ্ছেন। বাজারে যে ফন্টগুলো পাওয়া যায় সেই ফন্টগুলো আপনাদের ফন্টের চেয়ে মানের দিক থেকে বহুগুণে ভালো। সেই ফন্টগুলো ব্যবহার করাটাই আপনাদের জন্য অনেক ভালো হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এই কথাগুলো নির্বাচন কমিশন এবং তাদের গুরুদেরকে বোঝাতে পারিনি। তখনকার নির্বাচন কমিশন সচিব মহোদয় বস্তুত এককভাবে এই অপ্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন করেন। তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নিকস ফন্ট তৈরি করেন এবং নিকস এখন বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে।

সেটি বস্তুত পেশাদারি মান নিয়ে তৈরি করা হয়নি এবং আকার-আকৃতি যা দেখেছিলাম তাতে বোঝা গিয়েছিল যে, অপেশাদার ননটাইপোগ্রাফাররা এই ফন্ট নিয়ে কাজ করেছে। আমি ধারণা করি, মনে করা হচ্ছিল যে, ফন্ট তৈরি করা বোধ হয় আসলেই কেবল কম্পিউটারের কাজ। তারা বুঝতে পারেননি যে, বাংলা হরফমালা যা দিয়ে আমরা বাংলা ফন্ট বানাচ্ছি এটি কেবল কম্পিউটারের কাজ নয়, এটি আসলে টাইপোগ্রাফির কাজ। কম্পিউটারের জন্য ডিজিটাইজ করা দরকার হলেও ডিজাইনটা টাইপোগ্রাফারের। এই টাইপোগ্রাফির কাজগুলো একটি পেশাদারি ডিজাইনের কাজ। আমরা সকলে টাইপোগ্রাফার না। এমনকি কেউ কেউও নয়। সকলের পক্ষে টাইপোগ্রাফারের কাজ করা সম্ভবও না। পৃথিবীতে বাংলা হরফ নিয়ে যেসব মহত্ ব্যক্তি কাজ করেছেন তার মধ্যে আমি উইলকিন্সের কথা বলেছি। ফিওনা রস নামে একজন ভদ্র মহিলা আছেন তিনিও বাংলা নিয়ে টাইপোগ্রাফির কাজ করেছেন। ফিওনার সাথে টম হলওয়ে কাজ করেছেন। একইভাবে সত্যজিত্ রায় কাজ করেছেন। আমাদের এখানে কাইয়ূম চৌধুরীকে দিয়ে একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি যখন ফন্ট নিয়ে কাজ করি তখন টাইপোাগ্রাফার খুঁজতে থাকি। অন্তত কয়েকজনকে কাজ দিয়ে কাজ করাতে সক্ষমও হয়েছিলাম। প্রথম কাজ করেছিলেন হামিদুল ইসলাম। পরবর্তীকালে কাজ করেন শিবনারায়ণ দাশ। তারপর উজ্জল কুমার মজুমদার। তারপরে কাজ করেন মাকসুদ সাহেব। এরপরে আমাদের নিজেদের ইনহাউজ ডেভেলপমেন্টের ফলে টাইপোগ্রাফিতে আমাদের দক্ষতা অনেক বেড়ে যায়। যে কারণে আমরা প্রায় শ'-এর কাছাকাছি বাংলা ফন্ট তৈরি করতে পেরেছি।

স্মরণ করা ভালো যে, সরকার এর আগেও আরো একবার ফন্ট তৈরি করেছিল। সেটি করা হয়েছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের মাধ্যমে। ওরা একটি সফটওয়্যারও বানায়। ওখানেও লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু সেই ফন্টটি এখন বিনামূল্যে পেলেও আর কেউ ব্যবহারই করে না। সম্ভবত কেউ জানেও না যে, কম্পিউটার কাউন্সিলের একটি ফন্ট আছে। ফলে সরকারের হাতে বাংলা ফন্ট তৈরির তৃতীয় প্রচেষ্টা হলো একাডেমী, ঢাবি ও এটুআই-এর যৌথ প্রচেষ্টা। প্রথম প্রচেষ্টা নয়। এটুআই-এরও এটি দ্বিতীয় প্রচেষ্টা।

যুক্তাক্ষর ও অন্য সমস্যা সমাধান: আমরা শুনেছি যে, এই ফন্ট দিয়ে বাংলা ইউনিকোডের যুক্তাক্ষর সমস্যার সমাধান করা হবে। কি দুর্ভাগ্য আমাদের যে, সরকারের এতগুলো প্রতিষ্ঠান, ইউএনডিপি ও ইউএসএইড জানে না যে, ইউনিকোড নিয়ে আমাদের যুক্তাক্ষর ভাঙার কোন সমস্যাই নাই। 'র্য' ও 'র্য' নিয়ে যে সমস্যা সেটি ডিএলএল-এর। আর বস্তুত ইউনিকোডের সমস্যা যুক্তাক্ষর নয়। বরং ইউনিকোডে দাড়ি আর দুই দাড়ি নিয়ে আমাদের যে সমস্যা সেটি সরকারের অবহেলার জন্য দুই বছরে ইউনিকোড কর্তৃপক্ষের কাছে তোলাই হয়নি। এই ফন্ট সেই সমস্যার কোন সমাধান করতেই পারবে না।

প্রমিত কীবোর্ড: সরকারের বাংলা প্রমিত কীবোর্ড নিয়ে আছে এক মহাকেলেঙ্কারির ইতিহাস। ২০০৩ সাল থেকে সেই কেলেঙ্কারি বহমান হয়ে আছে। বলা হচ্ছে যে, সরকার সেই প্রমিত কীবোর্ডের সমাধান করবে। অথচ কীবোর্ড নিয়ে খোদ সরকারের বিরুদ্ধে পাইরেসির অভিযোগ এখন কপিরাইট অফিসে বিচারাধীন রয়েছে।

ফন্ট কেন, কেন অন্য প্রযুক্তি নয়: সরকারের ফন্ট বানানোর এই ৩য় সরকারি প্রচেষ্টার মূল কারণ আমি জানি না; কিন্তু একটি বিষয় খুব ভালো করে বুঝি যে, এই মুহূর্তে যদি আমাদের রাষ্ট্র ভাষার উন্নয়ন বা গবেষণা কিংবা অগ্রগতির কথা বিবেচনা করা হয় তাহলে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ ফন্ট নয়। অর্থাত্ আরেকটি বাংলা ফন্ট তৈরি করে বাংলা ভাষার জন্য আমরা খুব অগ্রগতি সাধন করে ফেলবো, বিষয়টি তেমন নয়। তার কারণ হচ্ছে যে, বাংলা মুদ্রণযোগ্য যন্ত্রে ফন্ট হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে বহু বছর যাবত্; অন্তত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে অসাধারণ ডিজিটাল ফন্ট আমরা ব্যবহার করে আসছি এবং সরকারের আরেকটি ফন্ট আসলে ব্যবহার বা তৈরি করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যে জায়গাটিতে সরকারের সহায়তার প্রয়োজন ছিল সেটি হচ্ছে যে, ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ব্যবহার করার অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে বাংলা ব্যাকরণ। যার মধ্যে বানান শুদ্ধ করার প্রক্রিয়াসহ ব্যাকরণ শুদ্ধ করার প্রক্রিয়া থাকতে পারতো। একই সাথে আমরা এখন যে চ্যালেঞ্জ সবচেয়ে বেশি মোকাবিলা করছি সেটি হচ্ছে অপটিকেল ক্যারেক্টার রিডার পাওয়া। যেসব মুদ্রিত পাঠ্য বিষয় আছে সেগুলোকে টাইপ করে ডাটা এন্ট্রি না করে স্ক্যান করে ওসিআর দিয়ে যদি এটাকে পাঠযোগ্য অথবা সম্পাদনাযোগ্য করতে পারি তবে সেটি আমাদের জন্য একটি বড় ঘটনা হতে পারতো। এছাড়া বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে যে, আমরা টেক্সকে স্পিচে রূপান্তর করতে পারি কিনা।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই কাজগুলোর কোনটাই সফল হয়নি। বেসরকারি খাত এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে না। এর কারণ হচ্ছে, এর বাণিজ্যিক ভিত্তি মূলত নাই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এটি একটি পাইরেসি কবলিত দেশ। সুতরাং এখানে নতুন কোন কিছু তৈরি করে সেখান থেকে যে উন্নয়ন ব্যয় তুলে আনা যাবে এটা প্রায় দুরূহ কাজ। ফলে এসব খাতে ব্যক্তি খাত থেকে ইনভেস্ট করার সম্ভাবনা তেমন নেই। সরকারি খাত থেকে উদ্যোগ নেয়া সম্ভব ছিল। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলাম যে, এই উদ্যোগগুলো নেয়া যায় কিনা। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও প্রায় চার বছর ধরে নানা ধরনের অজুহাত তৈরি করে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়নি। বেসরকারি সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিল একটি বিদেশি অনুদান দিয়ে। কিন্তু তারাও কাজটি অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। যারা ওপেন সোর্সের কাজ করেন তারাও এ ধরনের কাজগুলোকে সামনে নিয়ে যাননি। কারণ শখ করে এ কাজগুলো করা সম্ভব না। এজন্য পেশাদারিত্ব প্রয়োজন আছে। সুতরাং সার্বিকভাবে যদি বলা হয় তাহলে আমি একথাটি বলবো যে, আসলে আমাদের আরেকটি বাংলা হরফমালা তৈরি করার চাইতে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য ব্যাকরণ, বানান শুদ্ধিকরণ, টেক্স টু স্পিচ, স্পিচ টু টেক্সট, অপটিকেল ক্যারেক্টার রিডার এই কাজগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমি অনুরোধ করবো যে, ইউএনডিপি বা এটুআই কিংবা কম্পিউটার কাউন্সিল অথবা সরকারের অন্য কোন সংস্থা যদি এই বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয় তাহলে আমাদের এই দুঃখিনী বর্ণমালা অনেক বেশি খুশি হবে।

আমি খুব খুশি হতাম যে, সামনের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে যদি আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হাতে স্পেল চেকার অথবা গ্রামার চেকার অথবা একটি অপটিকেল ক্যারেক্টার রিডার অথবা টেক্স টু স্পিচ বা স্পিচ টু টেক্সট ধরনের কোন সফটওয়্যার উদ্বোধন হতে দেখতাম। আমার ধারণা যে, আমাদের এই প্রত্যাশা পূরণ হবার নয়।

লেখক :তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com
Source: http://ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDJfMjNfMTNfMV81XzFfMjExMTk=
******************************************************************************
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment