Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

সান্তালি ভাষা লেখার ক্ষেত্রে রোমান বর্ণমালা না বাংলা বর্ণমালা

গাব্রীয়েল হাঁসদা    ফেব্রুয়ারী ০৯, ২০১৩, শনিবার,     ১২:৩৪:০৮

এখানে ‘সাঁওতাল’ শব্দের পরিবর্তে ‘সান্তাল’ শব্দ ব্যবহার করেছি। কারণ সাঁওতালরা নিজেদেরকে ‘সান্তাল’ বা ‘হড়’ বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। আর নিজের নামের ব্যাপারে প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ ও মতামত থেকে থাকে। সুতরাং, এনিয়ে আশা করি পাঠকগণ আমাকে ভুল বুঝবেন না।

এবার মূল কথায় আসি। ইদানীং বাংলাদেশে সান্তালদের মাতৃভাষা লেখার ক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা না রোমান বর্ণমালা বেশি উপযোগী এনিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। গত ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ খ্রিঃ রাজশাহীর দৈনিক ‘সোনার দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. সুজিত সরকার-এর লেখা ‘আদিবাসীদের শিক্ষার মাধ্যম ও প্রাসঙ্গিকতা’ মতামত পাঠ করেছি। স্যার-এর লেখা পড়ে এবং সান্তালদের মাঝেও নিজ মাতৃভাষা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও উদ্বিগ্নতা ভেবে আমিও কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেছি।
এখানে স্যারের প্রতি সম্মান রেখেই প্রথমে বলতে চাই উনার লেখায় মূল বক্তব্য বিষয়ে কেমন যেন একটু গোলমেলে মনে হয়েছে। উনি লিখেছেন ‘আদিবাসী ছাত্র পরিষদ’ তাদের প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার দাবিতে আন্দোলন করছে।’ আমরা সকলেই জানি, বাংলাদেশে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম বাংলা রয়েছেই। সুতরাং, নতুন করে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা চায় এমন দাবি করার কোনো যুক্তিই আসে না। আর আদিবাসীরা কিন্তু শুধু একটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নয়। আদিবাসী বলতে বাংলাদেশে ২৯/৪৫টি (সংখ্যা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন মত রয়েছে) আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষকে বোঝানো হয়ে থাকে। সুতরাং, এখানেও সকল আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাতৃভাষার কথা আসার বিষয় নয়। আমি যতটুকু জানি আদিবাসী ছাত্র পরিষদ দুটি ভাষা ‘সান্তালি’ এবং ‘সাদরি’ বিষয়ে বলতে চেয়েছে। আর আমরা যারা সান্তালি ভাষা লেখার জন্য রোমান বর্ণমালা চাইছি, তারা শুধু সান্তালি ভাষার কথা বলতে চেয়েছি, অন্যের ভাষার বিষয়ে নাক গলাতে চাই না। এই প্রসঙ্গে আমাদের মূল কথা হচ্ছে- বাংলা বর্ণমালায় লেখা সান্তালি ভাষার অনেক শব্দের উচ্চারণ শুদ্ধ বা সঠিকভাবে আসে না। কিন্তু রোমান বর্ণমালায় লেখা সকল সান্তালি শব্দের সঠিক উচ্চারণ আসে। এখানে সান্তালি ভাষার লিখিত রূপ প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে বলতে চাই যে, সান্তালি ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই (যদিও ‘অলচিকি’ বর্ণমালাকে বর্তমানে নিজস্ব দাবি করা হয়। এই বিষয়ে এখন কিছু বলছি না)। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের উড়িষায় জলেশ্বর মিশনে রেভা: জে. ফিলিপ (একজন খ্রিষ্টান মিশনারি) প্রথম ১৮৪৫ খ্রিঃ বাংলা বর্ণমালায় সান্তালি ভাষা লেখার চেষ্টা করেন। তিনি কিন্তু শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে, বাংলায় সান্তালি শব্দের সঠিক উচ্চারণ আসছে না। সুতরাং, তিনি রোমান বর্ণমালায় সান্তালি ভাষা লেখা শুরু করেন এবং ১৮৫২ খ্রিঃ ‘অহ ওহঃৎড়ফঁপঃরড়হ ঃড় ঝধহঃধষর খধহমঁধমব’ নামে একটি পুস্তক সান্তালি ভাষা শেখার জন্য রোমান বর্ণমালায় প্রকাশ করেন। এই ১৮৪৫ থেকে ১৮৭৭ খ্রিঃ পর্যন্ত এবং পরবর্তী সময়েও সান্তালি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞগণ- জবা. খ. ঙষংবহ ঝশৎবভংৎঁফ, জবা. ঊ.খ.চীঁষবু, উৎ. খবঢ়ংঁং, জবা. অহফৎবি ঈধসনবষষ, জবা. চধঁষ ঙষধভ ইড়ফফরহম সান্তালদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বহু গবেষণা/স্টাডি করেছেন এবং ভালো ভালো তথ্য সমৃদ্ধ পুস্তক রচনা করে গেছেন। এই ভাষা প-িতগণ সান্তালি ভাষার জন্য প্রয়োজনীয় রোমান বর্ণমালায় ফরধপৎরঃরপধষ সধৎশং (ধ্বনি-চিহ্ন) ব্যবহার করে সেগুলোকে সান্তালি ভাষার ধ্বনি উচ্চারণের উপযোগী (ংঃধহফধৎফ ধষঢ়যধনবঃ) করে তোলেন এবং ১৮৬৩ খ্রিঃ থেকে তা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং ক্রমে ক্রমে নেপাল, ভুটান, বালাদেশ ও যে সকল দেশে সান্তাল লোকেরা রয়েছে সেখানে এই বর্ণমালায় সান্তালি ভাষা লেখা হচ্ছে এবং তা সান্তালি ভাষা লেখার উপযোগী (ংঃধহফধৎফ ধষঢ়যধনবঃ) বর্ণমালা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
সম্মানীয় অধ্যাপক মহোদয় ড. সুজিত সরকার তাঁর লেখায় ছাত্র পরিষদের রেফারেন্স দিয়ে এবং নিজস্ব তথ্য ও ভাবনা প্রসূত অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। আমি কিন্তু অত কিছু বলতে চাইছি না। শুধু প্রাসঙ্গিক আদিবাসী সান্তালদের ভাষার বিষয়ে বলতে চাইছি।
সম্মানীয় স্যারের লেখায় বোঝা যাচ্ছে- আদিবাসী/সান্তাল ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার উন্নয়নে বাধা বা নষ্টের জন্য রোমান বর্ণমালার সমর্থক এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগণকে ঢালাওভাবে দোষ দেয়া হয়েছে, এটা কিন্তু ঠিক নয়। যদি চ্যালেঞ্জে আসা হয় তবে দেখে যাবে সান্তালদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোককাহিনি, পৌরাণিক কাহিনি/ইতিহাস, গান, সান্তালি ভাষার অভিধান, ভেষজ চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সমৃদ্ধ প্রাচীন পুস্তকগুলো অধিকাংশ রোমান বর্ণমালায় রচিত এবং সেখানে খ্রিষ্টান অখ্রিষ্টান বলে কোনো কিছু নেই। এই সকল পুস্তকের রচয়িতাগণ যদিও অধিকাংশ বিদেশী খ্রিষ্টান এবং সান্তাল খ্রিষ্টান, বেশকিছু সনাতন বিশ্বাসী সান্তালও (অখ্রিষ্টান) রয়েছেন। আর বর্তমানে আমরা শুধু খ্রিষ্টানরা রোমান বর্ণমালা চাইছি তা নয়। সনাতন-বিশ্বাসী সান্তালগণও যারা বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝেন তারাও রোমান বর্ণমালা চাচ্ছেন এবং আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সান্তালি ভাষা শেখার বিষয়ে বলতে গেলে বিভিন্ন নথিপত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়- মিশনারি স্কুল ও হোস্টেলগুলোতে ব্রিটিশ আমল থেকেই সান্তালি ভাষা রোমান বর্ণমালায় শেখানো হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। কিছু কিছু এনজিও চালিত স্কুলেও এক্সট্রাকারিকুলাম হিসেবে সান্তালি ভাষা রোমান বর্ণমালায় শেখানো হচ্ছে।
সুতরাং, সান্তালদের ভাষা, সংস্কৃতি বিষয়ে লিখিত রূপে এবং চর্চা/অনুশীলনেও কে রক্ষা করছে তা পরিষ্কার। আপনারা কেউ যদি সান্তালদের ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে প্রাচীন তথ্য পেতে ও বিস্তারিতভাবে স্টাডি করতে চান তাহলে রোমান বর্ণমালায় রচিত বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হবেই। এখানে পাঠকগণের কাছে ক্ষমা চাইছি- সান্তালদের মাঝে খ্রিষ্টান অখ্রিষ্টান প্রসঙ্গ আনা আমার একদম ইচ্ছে নেই, তবে বিষয়টি অধ্যাপক মহোদয়ের লেখায় সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এসে গেছে। আসলে সান্তাল আমরা একই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, ধর্ম ভিন্ন হতে পারে। বাঙালি যেমন একই জাতি, শুধু ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সনাতন, বৌদ্ধ ও ইসলামে বিভক্ত (বাঙালি জাতি বিষয়ে ভুল তথ্য দিলে, ক্ষমা চাইছ)। অধ্যাপক মহোদয় যুক্তি দেখিয়ে লিখেছেন, ‘যেহেতু তাদের ভাষার কোনো লিপি নেই, তাই দেশভেদে আদিবাসীদের সেই দেশের প্রধান ভাষার লিপিতে নিজেদের ভাষা রূপান্তর করে শিক্ষার আয়োজন করলে সেই আদিবাসী একদিকে যেমন নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির আলোয় উন্নত মানসিকতায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তেমনি নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেও দীর্ঘজীবী করতে সক্ষম হবে।’ অধ্যাপক মহোদয়ের এই কথার আংশিক সত্যতা রয়েছে, তবে সম্পূর্ণরূপে নয়। নিজেদের লিপি নেই বলে এবং সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষার লিপি নিতে হবে তা ঠিক নয়। এখানে মূল বিষয়টি দেখতে হবে- কোন লিপি বা বর্ণমালা দিয়ে কোন ভাষার শব্দগুলো সঠিক বা শুদ্ধ উচ্চারণসমেত লেখা যাবে। আমরা রোমান বর্ণমালার সমর্থকগণ আদিবাসী ‘সাদরি’ বা অন্য সকল আদিবাসীর ভাষার বিষয়ে বিছু বলতে চাই না। আমরা বলতে চাইছি- আদিবাসী শুধু সান্তালি ভাষা লেখার জন্য রোমান বর্ণমালা বিশুদ্ধ উচ্চারণে সক্ষম এবং বিগত ১৮৫২ খ্রিঃ থেকে রীতিমতো প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত। এই বর্ণমালায় বহু আগে থেকেই সান্তালদের ভাষা, ইতিহাস, সাহিত্য, লোককাহিনি, অভিধান, সমাজ, সংস্কৃতি, সান্তালি ভেষজ চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে বহু বই রচিত ও সংরক্ষিত রয়েছে। তারপরেও অধ্যাপক মহোদয়ের যুক্তি এবং আদিবাসী ছাত্র পরিষদের যুক্তি মানতে হলে তো বলতে হয়, যে সকল বাঙালি ভাইবোনেরা ইউরোপ, আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তাদেরকেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষা ইংরেজি বর্ণমালায় বাংলা ভাষা লিখতে হয়। এই বিষয়ে শিক্ষিত মহল নিশ্চয় জানেন ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিস, ইতালি ইত্যাদি ইউরোপের অনেক ভাষার বর্ণমালা রোমান বর্ণমালা থেকে এসেছে। এই কারণে কি তাদের জাত মান যাচ্ছে? আর তাদের মনমানসিকতা ও শিল্প সাহিত্যের উন্নতি কি হচ্ছে না? এখানে অধ্যাপক মহোদয়ের আর একটি বাক্যের উদ্ধৃতি দিচ্ছি- - ‘ - রোমান হরফের সমর্থকদের মতো দালালেরা অর্থের বিনিময়ে বিভাজন তৈরি করবে, নিজেরা লাভবান হবে।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামকরা একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক অবলীলাক্রমে রোমান হরফের সমর্থকগণকে ‘দালাল’ বলে অভিহিত করলেন। তিনি বাংলা বিভাগের প্রফেসর এই জন্যই মনে হয় এমন ভাষা প্রয়োগ করতে পারলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে অধ্যাপক মহোদয়কে বলতে চাইছি, আদিবাসী ভাষা নিয়ে আপনার লেখায় যেরূপ আক্রোশ প্রকাশিত হয়েছে, সেই তুলনায় সান্তালি ভাষা বাংলা বর্ণমালায় লিখলে শাব্দিক/(ধ্বনিগত) উচ্চারণ কতটুকু সঠিক হবে এই বিষয়ে বাস্তব কোনো যুক্তি পাই নি। আমরা পিছিয়ে পড়া মানুষ, লেখাপড়া কম জানি তাই বুঝি বিষয়টি আমলে আনার প্রয়োজন মনে করেন নি। আপনি দালালদের বহু অর্থ রয়েছে এই কথাও লিখেছেন। আপনার কথা মতো সত্যি আমাদের এত অর্থ থাকলে নিজেদেরকে ধন্য মনে করতাম এবং ইতোমধ্যে সান্তালদের বিষয়ে অনেক গবেষণার কাজ ও প্রকাশনা বের করতে পারতাম। এই বিষয়ে সত্যি বলছি, যদিও অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। আমি নিজেও সান্তাল আদিবাসীদের বিষয়ে টুকিটাকি লেখালেখি ও প্রকাশনা বের করেছি। প্রকাশনার জন্য মিশনারিদের কাছে এবং তাদের সাহায্য সংস্থায় আর্থিক সাহায্য পেতে কখনো সক্ষম হই নি। এ থেকে এটাই বলতে চাইছি, টাকা পাওয়া এত সহজ নয় এবং টাকার বিনিময়ে মিশনারিগণ আদিবাসীদের ভাষা সংস্কৃতি নষ্ট করছেন এরূপ ধারণা পোষণ করা এবং প্রচার করা রীতিমতো অন্যায়। আদিবাসী ভাষা বাংলা বর্ণমালায় লেখানোর জন্য আদিবাসী ছাত্র পরিষদের যে দাবি তার প্রতি সমর্থন দেয়ার উদ্দেশ্যে আপনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আহ্বান জানিয়েছেন। স্যার, এখানে আবারো বলতে চাই- আপনারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষ- জনবল, অর্থবল, জ্ঞানবল, সাংস্কৃতিক প্রভাব, রাজনৈতিক শক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক সুবিধা সকল কিছুই আপনাদের অনুকূলে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে আমদের মতো দালালদেরকে শায়েস্তা করতে আপনাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। তবে আমি বিনম্রভাবেই বলতে চাইছি, অধ্যাপক মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক, বাংলা ভাষা ও ধ্বনি বিষয়ে নিশ্চয় উনার অনেক জ্ঞান আছে বিশ্বাস করি। অনুরূপভাবে সান্তালি ভাষা ও শব্দ-ধ্বনি বিষয়েও তো স্ট্যাডি করা প্রয়োজন। তবে তো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সমর্থনের জন্য আহ্বান করা যাবে। নইলে তাদের সমর্থন যে অন্ধ সমর্থন হয়ে যাবে। সুতরাং সাংগঠনিক/রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে নয়, বরং কেউ সান্তালি ভাষা ও ধ্বনি বিশেষজ্ঞ থাকলে বা অন্তত যারা সান্তালি ভাষা শুদ্ধ উচ্চারণ সমেত জানেন তাদের সহোগিতায় আলোচনায় আসি এবং সান্তালি ভাষার জন্য বাংলা ও রোমান বর্ণমালা তুলনামূলক আলোচনা করি। আর এই বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিদের মাঝে যেমন বিশ্বব্যাপী ভাষা ও সাংস্কৃতিক মিল এবং যোগাযোগ রয়েছে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সান্তালদের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করি। অহেতু গালাগালি নয় আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চয় শান্তিময় সমাধান সম্ভব হবে।
এখানে, এখন সান্তালি ভাষা লেখার ক্ষেত্রে কেন রোমান বর্ণমালা ব্যবহার অব্যাহত রাখতে চাইছি এবং সরকারিভাবে সান্তাল শিশুদের জন্য নিজ মাতৃভাষায় পুস্তক রচনা করলে কেন সেক্ষেত্রেও রোমান বর্ণমালার ব্যবহার চাইছি তার কয়েকটি যৌক্তিকতা তুলে ধরছি।
১. বাংলা বর্ণমালায় লেখা সান্তালি ভাষার অনেক শব্দ সঠিক উচ্চারণ আসে না। তার বাস্তব উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
গত ১৯৯৯ খ্রিঃ জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে এবং দারিদ্র্য বিমোচন গবেষণা কর্মসূচি, গ্রামীণ ট্রাস্ট-এর সহযোগিতায় পরীক্ষামূলকভাবে সান্তাল শিশুদেরকে বাংলা ভাষার পাশাপাশি তাদের নিজ মাতৃভাষা বাংলা বর্ণমালায় রচিত বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। উক্ত গ্রামীণ ট্রাস্টের সহযোগিতায় গত ২০০০-২০০২ খ্রিঃ মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা বর্ণমালায় লিখিত পুস্তকগুলো তাদের ব্যবস্থাপনায় চালিত গোদাগাড়ী উপজেলায় ৪/৫ টি প্রি-প্রাইমারি স্কুলে সরবরাহ করা হয় এবং ৩ থেকে ৪ বছর অবধি পড়ানো হয়েছিল। বর্তমানে আর পড়ানো হয় না। আমি তাদের রচিত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সকল পুস্তক বিস্তারিতভাবে পাঠ করেছি এবং সকল পুস্তকেই নিম্নের ত্রুটিগলো এবং আরো অন্যান্য ত্রুটি ব্যাপকভাবে পাওয়া গেছে। পঠিত পুস্তক সকল ১) আবোয়াঃ পুথি- পাহিল, ২) আবোয়াঃ পুথি- দোসার, ৩) আবোয়াঃ পুথি- তেসার (প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত), ৪) সেবেল সড়ম কিসৗবোন আঞ্জম (গল্পের বই), ৫) সেরমা সেতঙ (আদিবাসী কাব্য ও শিল্প বিষয়ক পত্রিকা)। উল্লিখিত পুস্তকগুলো পড়ে সকল পুস্তকেই এবং বহু পৃষ্ঠায় নিম্নের শব্দগুলো যা প্রশ্নবিদ্ধ এবং আরো অন্যান্য ত্রুটিপূর্ণ শব্দ ব্যাপকভাবে পাওয়া গেছে।
ত্রুটিসমূহ- ক) একই শব্দের বিভিন্ন বানান- {(চেৎ, চেঃৎ), (কাটিঃচ্, কাটিচ, কৗটিচ), (তৗরুপ্, তৗরুপ, তৗরুঃপ), (গচ্, গঃচ্, গঃচ), (এহোপ, এহঃপ, এহঃপ্, এহপ), (লাগিৎ, লৗগিত, লৗগিঃৎ), (লুতুরতেহঁ, সেতং-হঁ, তৗসহোঁ, সুখ হোঁ)}, খ) অশুদ্ধ উচ্চারণ- (পাহিল, এনেজআ, গেলেআ, মেনাআ, বাঞ্চাআ, চপতহঁ, তুয়ু)।
ক) উল্লিখিত শব্দগুলো রোমান বা অৎরধষ টহরপড়ফব গঝ ভড়হঃ দিয়ে একইরূপ বানান ও শুদ্ধভাবে লেখা যায় এবং তা অর্থপূর্ণ হয় যেমন- (পব, শর, ঃৎ, মড়, বযড়, ষমর, ষঁঃঁৎঃব যষ্ফ, ংবঃড় যষ্ফ, ঃরং যষ্ফ, ংঁশ যষ্ফ খ) শুদ্ধ উচ্চারণ- (চযরষ, বহবলড়ধ, মবষবধ, সবহধধ, নধপধধ বা নধপধড়ধ, পড়ঢ়ড় যষ্ফ, ঃড়ুড়)। ক) এই শব্দগুলোর বাংলা অর্থ (শিক্ষা, ছোট, বাঘ, মরা বা মৃত, শুরু, জন্য, কানেও, রৌদ্রেও, কখনো, সুখও)। খ) (প্রথম, নাচবে, শিষ ফুটবে, আছে, বাঁচবে, নীচুও, শিয়াল)।
এখানে দেখা যাচ্ছে একটি সান্তালি শব্দকে বাংলা বর্ণমালায় দুই থেকে চার রকম পর্যন্ত বানানে লেখা হয়েছে, যেমন এহোপ, এহঃপ, এহঃপ্, এহপ (অর্থ- শুরু)। এখন পাঠক ম-লী বুঝুন কোন বানানটি সঠিক এবং শুদ্ধ উচ্চারণ কি? এইভাবে সান্তাল ছেলেমেয়েরা কি কখনো সঠিক বানান এবং শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে পারে? উল্লিখিত বইগুলো পাঠ করলে দেখা যাবে এরূপ আরো বহু ভুল উচ্চারণ শব্দে পূর্ণ রয়েছে যা ছেলেমেয়েদের জন্য শব্দের বানান এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিভ্রান্ত সৃষ্টি করতে বাধ্য। রোমান বর্ণমালায় কিন্তু একইরূপ বানান এবং শুদ্ধ উচ্চারণ আসে (বযড়)।
২. রোমান বর্ণমালার ব্যবহার বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপাল দেশে সান্তালদের মাঝে ব্যাপক এরিয়ায় বিদ্যমান রয়েছে। আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা, উড়িষায় অলচিকি ও বিহারে দেবনাগরী/হিন্দি বর্ণমালা সীমিত এলাকায় সান্তালদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে। এই রোমান বর্ণমালা সান্তালি ভাষা ও কৃষ্টিতে ইতিহাস এবং ঐতিহ্য (১৮৪৫ খ্রিঃ থেকে) গড়ে তুলেছে এবং প্রতিষ্ঠাও লাভ করেছে। সান্তাল জনগোষ্ঠী ও দেশি-বিদেশি শিক্ষিত মহলে এর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। তাঁরা এই বর্ণমালায় লেখা বইপুস্তক সঠিক উচ্চারণ সমেত সহজে পাঠ করতে পারবেন ও বুঝতে পারবেন। এই বর্ণমালায় লেখা সান্তালি ভাষার অভিধান এবং সান্তাল জাতি, কৃষ্টি, সমাজ, চিকিৎসা, লোকসাহিত্য, গল্প কাহিনি, কবিতা, গান ইত্

Source: http://www.dailysonardesh.com/DetailsNews.php?Id=8196
*****************************************************************************
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment