Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

আন্তর্জাতিক মহান ভাষা দিবসে আদিবাসী ভাষার প্রশ্নে আমার অবস্থান


গতপরশু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের একটা সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন পড়লাম। সেখানে তিনি একটা ঘটনার কথা বল্লেন - "....লন্ডনপ্রবাসী এক বাঙালি একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি মাতৃভাষার শিক্ষার কথা বলছেন। আমাদের মাতৃভাষা সিলেটি। আমরা কেন সিলেটি ভাষায় শিক্ষা নিতে পারব না?’"


প্রতিবেদনটি অনেক বেশী তথ্যবহুল। তাই সেটার প্রিন্ট নিয়ে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখে দিয়েছি। তবে এই পর্যন্ত পড়ার পর কিছু তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া লেখা প্রয়োজন বলে মনে করলামঃ



মাতৃভাষা বলতে একটা দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষাকেই বুঝায়, কোন জেলা বা প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষাকে নয়। এবং সেই ভাষা একটি স্বাধীন এবং নির্দিষ্ট জাতিসত্ত্বা কর্তৃক চর্চা করা হয়। সুতরাং, মাতৃভাষায় শিক্ষা মানে মোটা দাগে রাষ্ট্রীয় ভাষায় শিক্ষাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এখন, সিলেটীরা যদি 'মাতৃভাষায় শিক্ষা' বলতে তাদের জন্য সিলেটী ভাষায় শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করার দাবী তুলবার চেষ্টা করে, তাহলে হয় তারা রাষ্ট্র আর আঞ্চলিক ভাষার মধ্যকার পার্থক্য বুঝে না (এবং ঐ সাক্ষাৎকারেই স্যার বল্লেন, "...আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আঞ্চলিক ও প্রমিত বাংলার পার্থক্য করতে না পারব, ততক্ষণ এ সমস্যা থাকবে....!") নয়তো তারা সিলেটী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে মনে করে।



অপরদিকে, কোন একটি দেশের স্বাতন্ত্র আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃত্বাত্তিক জনগোষ্ঠির জন্য (বাংলাদেশে যেমন: চাকমা, মারমা, মুরং, গারো, সাওঁতাল, অষ্ট্রেলিয়ায় যেমন এবোরেজিনাল, নিউ জিল্যান্ডে যেমন মাওরিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠি), তাদের জাতীয় বা উপজাতীয় ভাষাই হলো তাদের মাতৃভাষা। বাংলাভাষার সাথে সেসব ভাষার গঠনগত যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে রাজনৈতিকভাবেও। কেননা, সংখ্যালঘু আদিবাসী কোন ভাষাকে রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়না, দেয়ার কথাও নয়। অথার্ৎ, রাষ্ট্রভাষা সর্বদা সব জাগাতেই রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং পৃষ্ঠপোষকপ্রাপ্ত। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি না পাক, (অবশ্য সেটার প্রয়োজনও নেই), নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত হবার অধিকার আদিবাসীদের অবশ্যই রয়েছে। এটা রাষ্ট্রীয় অধিকার যেমন তেমনি মানবিক অধিকারও বটে। এই অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন "হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'" থেকে শুরু করে আমেরিকার রেড ক্রস, ইংল্যান্ডের এ্যামনেস্টি ইন্টারনেশনালসহ পৃথিবীর বাঘা বাঘা মানবাধিকার সংস্থাগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, সরকারের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। (বাংলাদেশে এ কাজের তৎপরতা কেমন, মিডিয়ায় কখনো সেই খবর আসেনি)।


অধিকারের ব্যাপার না হয় বাদই দিলাম, একটা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষার তাগিদে হলেও সরকারের উচিত, আদিবাসীদের নিজেদের ভাষায় শিক্ষাগ্রহনের ব্যবস্থা করে এই নৃত্বাত্তিক ভাষাগুলোকে সুষমভাবে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা। আশার কথা, রাজশাহী আর খাগড়াছড়ির আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবীর মুখে সম্প্রতী সাঁওতাল ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।


ভাষা রক্ষার ব্যাপারে শুধু শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেই হবে না। একবিংশ শতাব্দির এই চরম উৎকর্ষের যুগে ভাষাকে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য এবং সুষমভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে, একে প্রযুক্তি বান্ধবও করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মুনীর কি-বোর্ডের আবিস্কারক প্রযুক্তিবিদ জনাব মুনির হাসানের বক্তব্যের কিয়দংশ উল্লেখ না করলেই নয় - "আমরা জানি, শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকবে সেই ভাষাগুলো, যা কিনা প্রযুক্তিবান্ধব! সাধারণ একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যেসব ভাষার লিখিত রূপ নেই, সেই ভাষাগুলোর অধিকাংশই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। তারপর যখন গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলেন, তখন ভাষার একটি সিসা-রূপ আমরা দেখলাম। তারপর শুরু হলো সিসাবিহীন ভাষার বিলোপ। আর এখন এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি। এখন কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষাবিদদের পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদদেরও সক্রিয় হতে হবে।"

শুনেছি, কম্পিউটারে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষা লিখন পদ্ধতি নিয়েও গবেষনা চলছে, বেশ কিছু সাফল্যও দেখা গেছে। এটা একটা খুবই আশাব্যঞ্জক তথ্য। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আদিবাসী প্রযুক্তিবিদ মানচুমাহারার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। প্রমিত বাংলা ভাষার প্রযুক্তিকরনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।


বলতে গেলে, বাংলাদেশে এখন বাক স্বাধীনতা আর অসাম্প্রদায়িক উদারপন্থী চেতনার মেলবন্ধনের চমৎকার একটা স্বর্ণযুগ চলছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এত অসাম্প্রদায়িক এবং উদার রাজনৈতিক চেতনা ধারনে করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম (মূলধারা) সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই বিপুলসংখ্যক আদিবাসীদের ভাষা- শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতিকে আজ পর্যন্তও নিজেদের অংশ বলে মনে করতে পারার ব্যাপারে যথেষ্ঠ আন্তরিকতা দেখাতে পারেনি। ভাষাসহ আদিবাসী সংস্কৃতি এখনও আামদের সমাজের মূলধারায় অনেকটা 'অবাঞ্ছিত'। অথচ এর উল্টো হওয়াই উচিত ছিলো।

বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষার আন্তজার্তিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে পৃথিবীর অন্যতম ৪টি ভাষা পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা রয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা খুব একটা হেলা খেলার জিনিস নয়। সরকার এবং সমাজকে এ বিষয়ে অবশ্যই এ বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

আর তাইতো, সিলেটীদের পরিবর্তে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, আর বান্দরবানের চাকমা, মারমা, খাগড়াছড়ির সাওঁতাল এবং ময়মনসিংহের গারোসহ - সারা বাংলাদেশের বিশাল উপজাতী গোষ্ঠি যদি তাদের মাতৃভাষায় (যেটা দেশের রাষ্ট্রভাষা নয়) শিক্ষালাভের দাবী জানায়, সেটা আমার কাছে অনেক বেশী যুক্তিগ্রাহ্য।

[সিলেটী ভাষাকে যারা আদিবাসী ভাষার অংশ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে, তাদেরকে বলছি, সিলেটে বসবাসকারী অতি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা "পাত্র"-দের আলাদা সমাজ সংস্কৃতি ও ভাষা থাকলেও সে ভাষার কোন লিখিতরূপ বা বর্ণমালা নেই। জাতিগত ভাবে পাত্ররা “বোড়া” জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে পণ্ডিতরা অনুমান করে থাকেন। গ্রিয়ারসন সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত মনিপুরী, খাসি প্রভৃতি ভাষা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট তথা তৎকালীন আসাম অঞ্চলের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতি উপভাষা সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন সেখানে পাত্রদের ভাষার উল্লেখ নেই। পাত্রদের ভাষার কোনো লিপি নেই। এমনকী লিখিত কোন নিদর্শনও নেই তাদের ভাষায়। নিজেদেরকে তারা লালং জাতি হিসেবেই গণ্য করে।
(সূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা পরিচিতি, বাংলা একাডেমী।)

কাজেই, যে আদিবাসীদের নিজস্ব কোন বর্ণমালাই নেই, সে আদিবাসীরা মাতৃভাষায় কি করে শিক্ষালাভের দাবী করতে পারে?
এমনকি সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষায় চালু হওয়া সাওঁতালদেরও নিজস্ব ভাষা নেই। তাহলে তারা কিভাবে শিক্ষাপদ্ধতি চালু করলো?

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অর্থাৎ রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে দুই লক্ষাধিক সাঁওতাল বসবাস করে। তবে ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপাল মিলিয়ে পৃথিবীতে ৫২ লক্ষ লোক সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে। হাজার হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা এই সাঁওতালি ভাষারও কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খ্রিস্টান মিশনারিদের হাতে সর্বপ্রথম সাঁওতালি ভাষার লিখিত রূপ দেওয়া হয় রোমান হরফে। ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার লুথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে প্রথম সাঁওতাল ভাষার ব্যাকরণ ও অন্যান্য বই প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতালি বর্ণমালা তৈরি করে এবং তার সরকারি স্বীকৃতিও লাভ করে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দেশী শব্দগুলো প্রধানত সাঁওতালি ও মুন্ডা ভাষা থেকে আগত। (সূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা পরিচিতি, বাংলা একাডেমী। )]

কিন্তু সিলেটীদের যে অতি ক্ষুদ্র আদিভাষা রয়েছে, সেটার বর্ণমালা প্রণয়েনে সাওঁতালদের মত কেউ কখনো এগিয়ে এসেছে বলে শোনা যায়নি।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমি জানতে পারি, যেটা আমি আগে জানতাম না। সেটা হলো, "বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দেশী শব্দগুলো প্রধানত সাঁওতালি ও মুন্ডা ভাষা থেকে আগত।" তার মানে, রাষ্ট্রীয় ভাষার পরিগঠনেও আদিবাসী ভাষা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, এবং আমাদের দেশের আদিবাসী ভাষা এ ভূমিকা ইতিমধ্যেই রেখেছে!

(প্রাসঙ্গিক আরো তথ্য যোগ করার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু লেখার বাহুল্য কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় সে কাজ থেকে বিরত থাকলাম)


সারকথা হলো, আমি সেইসব উপজাতীদের পক্ষে, যাদের হাজারটা মৌলিক অধিকারের মত নিজের মায়ের ভাষায় শিক্ষার জন্যও দাবী জানাতে হয়, দেশের জনগন এবং সরকারের কাছে হাত পাততে হয়!

আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, তথা ৮ই ফাল্গুন, আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস। রাষ্ট্রীয় মূলধারার সুবিধা বঞ্চিত এইসব আদিবাসীদের প্রতি সন্মানার্থে, আমি আমার আজকের মহান ভাষা দিবসটি পৃথিবীর সকল আদিবাসী ভাষার প্রতি উৎসর্গ করলাম। 

Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment