Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

আদিবাসীদের ভূমি এবং সংস্কৃতি হারানোর কারণ ও উত্তরণের উপায়

জোবাইদা নাসরীন, শিক্ষকনৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাক-কথন
ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ  (১৯৭২-১৭৯০) এবং ১৯০৫ সালের স্বদেশী আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত ময়মনসিংহের মোট জনসংখ্যার ০.৮৯% হলো আদিবাসী (মান্দি, হাজং, বর্মন, কোচ, হদি, ডালু ও বানাই )। বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডটিতেই পরবর্তীতে তৈরি হয়েছিলো ব্রিটিশ বিরোধী তেভাগার লড়াই এবং যুগান্তকারী টঙ্ক বিদ্রোহ যার নেতৃত্বে মূলত ছিলেন হাজং নারীরা। যারা ভূমি এবং ফসল রক্ষা করতেই শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘জান দেবো, তবু ধান দেবোনা। সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি এই ভূখণ্ড রক্ষায় তাদের অবদান। অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে সময়ের অনিবার্যতায় বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিলো বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী জনগন, যার ফলশ্রতিতে ১৭৭০  ও ১৭৭৯ সালে সংঘটিতে হয়েছিলো তুয়ার বিদ্রোহ, ১৭৮৩ সালের খাসী বিদ্রোহ, ১৭৮৯ সালে গঞ্জাস বিদ্রোহ, ১৭৮৫ সালের প্রথম সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮০৮ সালের খান্দেশ আদিবাসী বিদ্রোহ , ১৮১৮ সালের ভীম আদিবাসী  বিদ্রোহ, ১৮৩১-৩২ সালে কোল বিদ্রোহ, ১৮৩২ সালে মানভূজ ভূমিজ বিদ্রোহ, ১৮৩৯ সালের নাগা বিদ্রোহ, ১৮৪৩ সালে দড়িসার খড় বিদ্রোহ, ১৮৫৫-৫৬ সালে দ্বিতীয় সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৯৫-১৯০১ সালের মুন্ডা বিদ্রোহ, ১৮৩৭ ও ১৮৮২ সালে গারো বিদ্রোহ, এরপর তৈরী হয় হাজং বিদ্রোহ, চল্লি¬শের দশকের টঙ্ক বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, নাচোল এবং তেভাগার লড়াই । সবই এদেশের ইতিহাস তবে বেশিরভাগই জাতীয়ভাবে স্বীকৃত নয়।
৫২ থেকে এখন পর্যন্ত শাসন শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যতো লড়াই হয়েছে সেখানে এগিয়ে এসেছেন এই অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ। মান্দি নারী গিদিতা রেমা প্রাণ দিয়েছিলেন ভূমি রক্ষায়পীরেন স্নালের রক্ত আজোও সরকারী উন্নয়ন ভাবনার বিরুদ্ধে একটি বড়োসড় প্রতিবাদের স্মারক হয়েই আছে। সেই রক্ত শুধূ বন রক্ষার জন্যই নয়, সেই রক্ত সেদিন ঝরেছিলো পুঁজিবাদী উন্নয়ন ভাবনার বিপক্ষেও। সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনের হত্যা করা হয়েছিলো এই অঞ্চলের আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলকে।

শুধু ইতিহাসেই নয়, সেই সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষির অমূল্য সম্পদ ময়মনসিংহ গীতাকায় রয়েছে মান্দিসহ অনেক আদিবাসী ভাষা এবং লোক সাহিত্যের প্রভাব। ইতিহাস তৈরি এবং লোক সাহিত্যের ভাণ্ডারে যে আদিবাসী মানুষদের অবদান সে মানুষদের ভুমি এবং সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। শুধু হুমকির মুখে বলা হলেও কম বলা হবে, বলা উচিৎ যে ইতোমধ্যেই তারা অনেক কিছূ হারিয়েছে। নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সংস্কৃতিকে অনুধাবন করি একটু ভিন্নভাবে, অর্থাৎ কোন মানব গোষ্ঠীর জীবন যাপন প্রনালীটিই হলো সংস্কৃতি। সেখানে ভূমিও সংস্কৃতির অংশ। তাই কোনটিকেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়না, যাবেনা। এই প্রবন্ধে তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবাসীদের ভুমি এবং সংস্কৃতি হারানোর কারণ কয়েকটি ভাগে দেখানো হয়েছে, যার মূল জায়গায় আছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতি, মিডিয়া এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতির দোলাচল। 

রাষ্ট্রীয় অভিঘাত:  বাংলাদেশে আদিবাসী জনগন
এই প্রবন্ধে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গেই বাংলাদেশের আদিবাসী’  জনগন না বলে বাংলাদেশে আদিবাসী জনগন বলা হয়েছে। কেননা বাংলাদেশে রাষ্ট্রটি এখনও বাঙালি বাদে অন্য কোন জনগোষ্ঠীকে সংবিধানে স্থান দেয়নি। এ কথা আমরা কম বেশি সকলেই জানি যে, বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল মান্দি, কোচ, বর্মণ আদিবাসী এলাকায় মধুপুর শালবনের দোখলাতে, কিন্তু সেই মানুষরা আজো সংবিধানের বাইরে। রাষ্ট্রীয় ক্যাপশনের উপজাতির  সঙ্গে নতুন যোগ হওয়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ (ক্ষুদ্র  নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০ এ ব্যবহৃত) কোনোভাবেই  আদিবাসী হিসেবে এই মানুষদের অস্তিত্ব রাষ্ট্র স্বীকার করতে চায়নি। যার পিছনের কারণও ভূমি। কারণ আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করলেই ILO কনভেনশন অনুযায়ী এই মানুষদের ভূমি অধিকার দিতে হবে। স্বীকার করে নিতে হবে তাদের প্রথাগত মালিকানার ধরণটিকে, যা করতে রাজী নয় সরকার। কারণ তা হলে আদিবাসীদের ভুমি দখল কঠিন হয়ে যাবে। আর এইভাবেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় আদিবাসীদের ভূমি হারানোর বিষয়টি। জুম, জমি, জঙ্গল থেকে ছিটকে পড়ে এই মানুষেরা।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত সাতটি (এর বেশি জাতির অস্তিত্বও থাকতে পারে) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সকলেই অমুসলিম। ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতির পরিচয় অন্তর্ভূক্ত না করা, বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে স্বীকৃতি না দেয়া এবং ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করার পর থেকে অমুসলিম এবং অবাঙালি জনগন রাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরণের দূরত্ব অনুভব করতে থাকে। তারা জাতি, ভাষাগত এবং ধর্মীয়ভাবে নিজেদের প্রান্তিক হিসেবে আবিস্কার করে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রটি তার বহত্ববাদী গণতান্ত্রিক চরিত্র থেকে দূরে অবস্থান করে। কেননা গনতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো বহুত্ববাদ। একক সংস্কৃতির পরিচয় বহনকারী রাষ্ট্র হিসেবে বংলাদেশে পরিচিতি লাভ করে। মুছে যেতে থাকে এর ভিতরে বসবাসকারী অন্য সংস্কৃতির মানুষের পরিচিতি এবং অস্বীকৃত হতে থাকে তাদের অস্তিত্ব।

কোথায় গেল এতো আদিবাসী মানুষ?
সেই টঙ্ক আন্দোলন থেকে দেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার কারণে অনেক আদিবাসী  পরিবার দেশ ছেড়ে চলে যায় এবং পরবর্তী সময়ে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অনেক মান্দি, হাজং এবং কোচ পরিবার দেশত্যাগ করে। ১৯৬৪ সালে আসাম থেকে বিতাড়িত হয়ে বহু মুসলমান উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তারা অনেকেই বসবাসের জন্য এই সব সীমান্ত এলাকা বেছে নেয়। সর্বস্ব খুইয়ে আসা এই উদ্বাস্তুরা কখনো কখনো স্থানীয় আদিবাসী বিশেষ করে মান্দি ও হাজংদের ওপর আধিপত্য চালানোর চেষ্টা করলে হাজার হাজার মান্দি ও হাজংরা ভয়ে দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলে যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় এই সব সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর বড় অংশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। উল্লেখযোগ্যসংখ্য আদিবাসী  নারী-পুরুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। লোকমুখে প্রচলিত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৬ সালে আরেকবার আদিবাসীদের একটি বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যায়। এইভাবে প্রায় প্রতি দশকেই দফায় দফায় দেশত্যাগের ফলে এই বৃহৎ ময়মনসংহে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমতে থাকে যার ফলে বেড়ে যায় তাদের জমি দখল।  পরবর্তীতে তাদের থেকে যাওয়া আত্মীয় স্বজনেরা ভুগতে থাকে এক ধরনের অনিরাপত্তায়, যার কারণে অনেকেই নিজের এলাকা ছেড়ে দিয়ে অন্য আত্মীয় স্বজনভুক্ত এলাকায় চলে যায়। হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের জমি কিংবা সুযোগ বুঝে প্রভাবশালী অনেকেই তাদের বাধ্য করেন এলাকা ছেড়ে চলে যেতে।
এর সঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো বাংলাদেশের ২০০১ সালে করা জরীপে আদিবাসীদের জনসংখ্যার চিত্র ১৯৯১ সালের মতোই আছে। এর রাজনীতি বোঝাও জরুরী।

ভূমি যখন কেন্দ্রে:
কোন মানুষকে শাসন শোষনের মূল জায়গা  হলো তার ভুমির উপর আঘাত করা। মার্কসবাদী অর্থনীতিতে বলা হয় উৎপাদন পদ্ধতি এবং উৎপাদনের উপকরন নিয়ন্ত্রন অর্থাৎ ভুমি নিয়ন্ত্রনে থাকলে নিয়ন্ত্রনে থাকবে সংস্কৃতি।  অর্থাৎ অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রন করবে উপরিকাঠামোর প্রপঞ্চ সংস্কৃতিকে। যদিও নব্য মার্কসবাদীরা  উদাহরণ দিয়ে বলেছেন আবার কখনও কখনও সংস্কৃতিও নিয়স্ত্রন করতে পারে ভূমিকে। যেখানে উপরি কাঠামোর প্রবঞ্চ হিসেবে সংস্কৃতির পরিবর্তন ভূমির কাঠামোও এবং মালিকানারও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তাই ভূমি এবং সংস্কৃতি  সবসময় এক ও অভিন্ন পাঠের বিষয়। বাংলাদেশে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষের কাছে ভূমি শুধূ ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে, ধর্ম, বিশ্বাস, আচার. লোক উৎসব, প্রকৃতিবন্দনার মতো জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। তাই ভুমিতে আঘাত করা মানে হলো সবগুলোকে আঘাত করা, জীবন পাল্টে দেয়া, যে জীবন আর তার হয়ে ওঠেনা।

প্রথাগত ভুমি মালিকানার অস্বীকৃতি:
প্রথাগত মািলকানার রাষ্ট্রীয় অস্বীকৃতি একভাবে উৎসাহিত করছে আদিবাসীদের ভুমির অধিকারহীনতাকে। বেশিরভাগ আদিবাসী সমাজেই  জমির মালিকানা রেজিস্ট্রিকৃত নয়। যার ফলে ভূমি দখল সহজ হয় এবং তৈরি করা হয় জমির  নকল মালিকানা। ভুমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর তাদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েযার ফলে অনেকেই দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়, কেউ কেউ প্রভাবশালী সংস্কৃতির সঙ্গে আর বেশি একাত্মতা প্রকাশের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দেখা গিয়েছে যে আদিবাসীরা ভূমি সংক্রান্ত কোনো মামলা করেলেও খুব কম জায়গাতেই বিচারের রায় তাদের পক্ষে যায়। সেখানেও কাজ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী অবস্থান।

মিডিয়া ও জ্ঞানের  রাজনীতি:
বাংলাদেশে টেলিভিশনসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারী প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই আদিবাসীদের সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখানো হয়। যেখানে, গান নাচ, লোক গাঁথা, আচার উৎসব এই গুলো দেখানো হয়। কিন্তু এই উপস্থাপণের  রাজনীতিতে  কিছুতেই স্পষ্ট হয়না রাষ্ট্রের সঙ্গে এই মানুষদের  শাসন শোষণের সম্পর্ক। আড়াল হয়ে যায় এই মানুষদের জীবন যাপনে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার বিপরীতে নির্দয় হস্তক্ষেপ। এর পাশাপাশি পাঠ পুস্তকে এই আদিবাসী  জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক উপস্থাপণ করা হয় (যেমন বাংলা পিডিয়ায় লেখা আছে, গারোরা লোহা বাদে সব খায়)। সংবিধানের ৩২ নং ধারা লংঘন করা পেশা ক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে  অন্তরায়।   অভিযোগ রয়েছে যে, চাকুরী ও শিক্ষা ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত  ৫% কোটা ঠিকমত ব্যবহার করা হয়না এবং এই বিষয়ে তথ্য ঠিকমতো পৌঁছানো হয়না।

উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন : জ্ঞাতি সম্পর্কে এর প্রভাব 
এখন আমি যে জায়গায়টায় আলাপ পাড়বো তা হলো কীভাবে মানুষের জীবনে ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রতিফলন ঘটে বিভিন্নভাবে। যেমন এক সময় ভারতের গারো পাহাড় এবং তুরা এলাকায় জুমে অভ্যস্ত মান্দিরা সমতল ভূমি অঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাসকারী মান্দিদের মাঝে আখিং প্রথার ভূমি ব্যবস্থা অচল। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, পার্বত্য এলাকা থেকে গারোরা সমতল ভূমি অঞ্চলে আসার পর বিশেষ কোনো মাহারীর লোকেরা বিশেষ কোনো ভূ-ভাগ বা অঞ্চল অধিকার করে একচ্ছত্রভাবে নিজ মাহারীর জন্য পৃথক অঞ্চল গড়ে তুলতে পারেনি। কেননা যখন পার্বত্য এলাকা থেকে এখানে এসেছিল এবং পরবর্তী কালে আবার অনেকেই ফিরে গেছে, তারা সদলবলে যাওয়া কিংবা আসা কোনোটিই করেনি। হয়তো মাহারীভুক্ত কয়েকটি পরিবার এসেছিল আবার কয়েকটি পরিবার চলে গেছে, আবার এর পাশেই হয়তো অন্য কোনো মাহারীর দলছুট দু-একটা পরিবার নেমে এসে বসতি শুরু করেছে। এভাবে পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে একই গ্রাম বা অঞ্চলে বিভিন্ন মাতৃগোষ্ঠীর লোকজন বসত তৈরি করেছে। ফলে, সেই গ্রাম-বা ভূ-সম্পত্তির কোনো একটি নির্দিষ্ট মাহারীর নামে না এসে সেই গ্রাম বা অঞ্চলে বসবাসকারী ভিন্ন ভিন্ন মাহারীর লোকদের দখলে চলে যাওয়ায় সেখানে বিশেষ কারণে আখিং অঞ্চল গড়ে উঠতে পারেনি। আবার সমতল ভূমিতে বসতি গড়ে তোলা সেই ছোট ছোট গোত্রাংশ ছোট ছোট গ্রামাংশ বা এলাকাংশ নিয়ে প্রথাগতভাবে ছোট ছোট আখিং গড়ে তোলার প্রয়াস পেলেও সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি নানা কারণে।
প্রকৃতপক্ষে মূল আখিং থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং দূরতর সেই স্থানে নতুন বসতি স্থাপনকারী সদস্যরা মূল আখিংয়ের সদস্য-সদস্যা হলেও মূল আখিং নকনা কর্র্র্র্র্র্তৃক নতুন সেই নির্মিত গোত্রের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। যার কারণে নতুন ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী পরিবারগুলো কোনো আখিং ভূমি গড়ে না তুলে তাদের অধিকৃত নতুন অঞ্চলের জমাজমি স্বাধীনভাবে চাষাবাদ ও ভোগ দখল করতে শুরু করে। পরে সেই পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও মূল পরিবার কর্তৃক অধিকৃত সম্পত্তি বিচূর্ণ হতে থাকে। অর্থাৎ একটি পরিবার বৃদ্ধি পেয়ে একাধিক পরিবার গঠিত হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে মূল পরিবার কর্তৃক অধিকৃত সম্পত্তি নবগঠিত পরিবারগুলোর মধ্যে ভাগবাটোয়ারাকৃত সম্পত্তির ওপর নবগঠিত পরিবারগুলোর একক মালিকানা তৈরি হয় এবং জ্ঞাতিদের যৌথবোধের ক্ষেত্রে পরিবর্তন শুরু হয়। মাহারীকেন্দ্রিক গোষ্ঠীবদ্ধতা থেকে পরিবারকেন্দ্রিক পরিচিতি এবং ব্যক্তিক পরিচিতি বড় হয়ে উঠতে থাকে। ভেঙ্গে যায় জ্ঞাতি সম্পর্কের পরিচিত রূপ।

ভাষার অধিকার
বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৬,০০০ ভাষা আছে। ইউনেস্কোর রিপোর্ট  অনুযায়ী ২০৯০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে প্রায় ৩,০০০ ভাষা। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই ৩,০০০ এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা গুলোও। বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা থাকলেও এখনও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। যার কারণে এখন পর্যন্ত আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ বিষয়টি স্বপ্ন্ হিসেবেই থেকে গেছে। প্রতিবছর ২১ ফেব্রয়ারীতে উচ্চারিত সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলার গৌরব গাঁথা কিছুতেই স্বীকার করেনি অন্য ভাষাভাষির মাতৃভাষাকে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার একদিকে যেমন ভুলিয়ে দিচ্ছে আদিবাসী সন্তানদের তাদের নিজের ভাষাকে অন্যদিকে নিজ মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষায় পড়তে গিয়ে আদিবাসী সন্তানরা অনেকেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গারো এবং হাজং ভাষার বর্নমালার লিখিত রূপ আছে, যার মধ্য দিয়ে তৈরি করা যায় বই পুস্তক। কিন্তু এটি এখনও করা হয়নি।

বনের নিয়ন্ত্রন:
আদিবাসী জনগণের জীবন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে বন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বাংলাদেশের মোট শালবনের  ১২০,২৫৫ হেক্টরের মধ্যে বৃহত্তর ময়মনসিংহে পড়েছে ১০৪,৬১৬ হেক্টর বন যার মূল অধিবাসী ছিলেন ২৫,০০০ মান্দি এবং কোচ জনগণ। বৃটিশ সময়ে মান্দি জনগনেরা চাষের জন্য উঁচু ভূমি লিজ এবং নিচু ভূমি নিজেদের নামে রেজিস্টি করতে পারতো। ১৮৭৮ সালে ভারতীয়  Tenancy Act’  এর আওতায় তারা নিচু জমি রেজিস্ট্রি করে। ১৯৫৫ এবং ১৯৬২ সালে দুই দফা সেই অধিবাসীদের মতামত অগ্রাহ্য করে মধূপুর শালবনকে  `National Park’   হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়এবং সেখানে জুম চাষ বন্ধ করে দেয়। ১৯৬২ সালে তার পরিবর্তে আপেল চাষের বাহাস তুলে বনে নিয়ে আসে বাঙালি লোকজনকে এবং পূর্বের অধিবাসীরা হারাতে থাকে তাদের বনের উপর অধিকার। ১৯৬৪ সালে তাদের অনেকের কাছ থেকে বনকেন্দ্রিক ভুমি নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৯৬৮ সালে  বন বিভাগ তাদের বনের অবৈধঅধিবাসী বলে বন থেকে  উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে। ১৯৮৩ সালে বন বিভাগ থেকে প্রকাশিত গেজেটে এই বনকেন্দ্রিক নির্ভরশীল আদিবাীদের খাজনা দেয়ার কথা বলা হয়। ১৯৮৩ সালেই সরকার মধুপুর বনকে খাস জমি হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ১৯৮৪ সালে বন বিভাগ আদিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ৪২,০০০ হেক্টার জমিকে ফরেস্ট ল্যাণ্ড হিসেবে ঘোষণা দেয়। এছাড়া ১৯৫৪-৫৫ সালে নেয়া RubberPlantation Project  এবং ১৯৮২ সালে করা Thana Afforestation  and Nursery development project’  আদিবাসীদের ভূমি ছাড়া করা বাদে কোনো কল্যানে আসেনি।
বর্তমানে ৬৩ গ্রামে ৮৬৩০ পরিবার মধুপুর বন এবং এর আশে  পাশে বসবাস করছে। বর্তমান হিসেব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, মান্দি ৪,১২৯ পরিবার ৮,১৭১.১৭ একর জমি ব্যবহার করছে সেখান বহিরাগত বাঙালিরা ব্যবহার করছে ৫,৫৪৭.১৭ একর বনভূমি। বন থেকে আদিবাসীদর এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ১৯২৭ সালে বন আইনের ৫,২২, ১২, ১৪ ধারা অমান্য করেছেযেখানে বলা আছে যেবনের আদি অধিবাসীরা বনকে তাদের গ্রামের বন হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। 
জানা যায় যে, সরকারের এখনও  ১০ কোটি টাকা মওজুত রেখেছেন মধূপুর বনে পিকনিক স্পট এবং দেয়াল তৈরির জন্য। ২০০০ সালে বাংলাদেশে সরকারের আরেকটি প্রকল্প ছিলো ৩,০০০ একর জমিতে  Eco Torusim Project’  তৈরি করার। সেটির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিলো প্রতিবাদ। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারী পুলিশের গুলীতে মারা যায় পীরেন স্নাল এবং আরও ২৫ জন আহত হন।

আদিবাসী নারী:
আদিবাসী নারীরা চর্তুদিক থেকে প্রান্তিক। তারা  জতিগত, ধর্মীয়, নারী হিসেবে তারা সমাজে সবচেয়ে বেশি নিপীড়সেন শিকার, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাদের  অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি দরিদ্র সীমায় আছেন আদিবাসী নারীরা। চার ধরনের প্রান্তিকতার কারণে অনেক ক্ষেত্রই রয়েছে মজুরী বৈষম্য এবং নিপীড়ন। বন থেকে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় বিতাড়িত হওয়া অনেক গারো নারীরা ঢাকা শহরে কাজ নিচ্ছে বিউটি পারলার গুলোতে, কিন্তু সেখানেও নারীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।  যে আদিবাসী নারীরা বন থেকে জীববিকা নির্বাহ করতো, গাছে তৈরি করতো প্রাকৃতিক রং, নিজেরা বুনতো নিজেদেরই কাপড়, দুনিয়া জুড়ে সেই প্রাকৃতিক রং এর চাহিদা থাকলেও সেই বাজার থেকে ছিটকে পড়েছে আদিবাসী মানুষেরা। বনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে নারী। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে আদিবাসী নারীদের নিজেদের পোষাক তৈরির প্রক্রিয়া থেকেও তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যার কারণে এখন আর বৃহত্তর ময়মনসিংহে সাতটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মান্দিদেরে কিছুটা নিজস্ব পোষাক ব্যবহারের প্রচলন এখনও আছে। আর বাকী ছয়টির নিজস্ব পোষাক হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।  বাংলাদেশে এখন আদিবাসীদের তৈরি তাঁতের কাপড়ের চাহিদা থাকলেও সেটি নিয়ন্ত্রন করছে বাঙালিরা। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থাপণার দোলাচালে তাদের সঙ্গে বাজারের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের আড়ং এথনিক ক্রেজএ শ্লোগান দিয়ে আদিবাসী গয়না এবং পোষাকের ডিজাইন জনপ্রিয় করলেও বাজারের সঙ্গে সরাসরি সখ্য হয়নি আদিবাসী নারীর। এটিই পুঁজিবাদের রাজনীতি, প্রান্তিকে রাখানোর রাজনীতি।
এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের নানা ধরনের নিপীড়ন যার পুরোটার কেন্দ্রেই আছে ভূমি দখল। মান্দি নারীরা সম্পত্তির সমস্ত মালিকানা পায় বলে মান্দি মেয়েকে বিয়ে করে তার থেকে জমি হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা অনেক বাঙালি পুরুষ মুসলিম ছেলেদের মধ্যে দেখা যায়। মান্দি সমাজে সম্পত্তি মানেই গোত্রের সম্পত্তি। আর এই ভাবেই তা হাতছাড়া হচ্ছে। এই প্রবণতার কারনে বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই মান্দি সমাজে পুরুষের সম্পত্তির মালিক হতে দেখা যাচ্ছে যা তাদের মাতৃসূত্রীয় সমাজের বিরুদ্ধে।
সম্পত্তির অধিকার জ্ঞাতি সম্পর্কে পরিবর্তন আনছে। যেহেতু আগে নারীরা সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক ছিল, সেখানে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক এবং পিতার সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য ছিল। এবং এই সম্পত্তির কারণেই মায়ের ক্ষমতার জন্য পিতার চেয়ে মামা ক্ষমতাবান। কিন্তু যখনই ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিতা সম্পত্তির অধিকারী হলো, তখন থেকেই পিতার সঙ্গে সম্পর্ক পরিবর্তিত হতে থাকল এবং পিতাই হয়ে উঠল পরিবারের ক্ষমতার উৎস।
বৃহত্তর ময়মনসিংহে  গত পাঁচ বছরে হিসেবে দেখা গিয়েছে যে, মোট ৪৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রভাবশালী বাঙালিদের দ্বারা । তবে এর পিছনে প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই কাজ করেছে ভুমি হাতিয়ে নেওয়ার বিষয় কিংবা পর্বেকার ভূমি বিষয়ে সংঘাত। আমরা সকলেই জানি যে, ধর্ষণ হলো যুদ্ধাপরাধ। ধর্ষণের মধ্য দিয়ে কোনো সমাজ এবং জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি মানসিক নির্যাতনে ফেলা হয়। ধর্ষণ  যুদ্ধ এবং বিভিন্ন দূর্যোগময় সময়ে সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তাই কোন জনগোষ্ঠীকে আঘাত করতে চাইলে প্রথমে আঘাত করা হয় সেই জনগোষ্ঠীর নারী সদস্যকে, যেন তারা মানসিক চাপে পড়ে।

উৎস: http://www.bsu1952.org/archive/articles/167-adibasi-vumi-songskriti-zobaida-nasrin-1

Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment