Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ মানবাধিকার

বাঁধন আরেং প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ 
 শিশু শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে শিক্ষালাভ করতে পারে না, যদি তারা শিক্ষক বা পাঠ্যপুস্তকের ভাষা যথাযথভাবে বুঝতে না পারে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। হয়তো এ কারণেই বিশ্বব্যাপী শিশুদের জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা ভাবা হয়। আমাদের দেশেও বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা যেন অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারে- এ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এর গুরুত্ব আরও বেশি অনুধাবন করা যায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ আদিবাসী শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ সরকারিভাবে ব্যবস্থা করার সুস্পষ্ট ঘোষণার মধ্য দিয়ে। অবশ্য বেসরকারিভাবে আরও আগে থেকেই সীমিত পরিসরে হলেও বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিজ নিজ ভাষায় শিশুদের শিক্ষাদান কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।


মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ মানবাধিকার এবং শিশু অধিকারের একটি বিষয়। শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা, মেধা বিকাশ এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শিশুর বিকাশ পরবর্তী সময়ে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে সহায়তা করে। গবেষণায় এমন আশাব্যঞ্জক বিষয়গুলোই লক্ষ্য করা যায়। দেশ ও জাতির উন্নয়ন সামনে রেখে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রয়োজনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় পড়ালেখা শেখার সুযোগ সৃষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামো, ভূমি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়ের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বিশ্লেষণ করেই বিভিন্ন দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আÍপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আদিবাসীবিষয়ক কনভেনশন ১৯৫৭, (কনভেনশন নং ১০৭) এবং এর সংশোধিত সংস্করণ কনভেনশন ১৯৮৯ (কনভেনশন নং ১৬৯) গ্রহণ ও ঘোষণা করে। কনভেনশন নং ১০৭-এর ২৩ অনুচ্ছেদের (১)-এ বলা আছে, সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় পড়া ও লেখার জন্য শিক্ষাদান করতে হবে। উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালের ১০৭নং আইএলও কনভেনশন নামে বহুল পরিচিত এ দলিলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার অনুস্বাক্ষর করে। কনভেশন নং ১৬৯-এর ২৮ অনুচ্ছেদের (১)-এ বলা আছে, সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের বাস্তবসম্মত উপায়ে তাদের নিজস্ব আদিবাসী ভাষায় অথবা তাদের জনগোষ্ঠী কর্তৃক সাধারণভাবে বহুল ব্যবহৃত ভাষায় পড়া ও লেখার জন্য শিক্ষাদান করতে হবে। একই অনুচ্ছেদের (৩)-এ বলা আছে, সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী ভাষা উন্নয়ন ও চর্চা সংরক্ষণ করা ও প্রসার ঘটানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের (২০০৭) অনুচ্ছেদ ১৪-এর ১, ২ ও ৩-এ আদিবাসী শিশুদের তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য তাদের সাংস্কৃতিক রীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পাঠদান ও শিক্ষাপদ্ধতি অনুসারে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং সেসবের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার, বৈষম্যহীনভাবে রাষ্ট্র প্রদত্ত সর্বস্তরের ও সব ধরনের শিক্ষালাভের অধিকার ও সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বের বিষয়ে বলা হয়েছে। শিশু অধিকার সনদের ৩০ অনুচ্ছেদেও আদিবাসী শিশুদের নিজের মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ (খ)-এ সমাজের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথভাবে সব নাগরিকের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়রা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সরকারিভাবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী দেশের অন্য ভাষার সব শিশুর জন্য তাদের নিজস্ব ভাষায় পড়ালেখা শেখার ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন (২০১৩)। কার্যক্রমটি বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এ শিক্ষানীতিতে নৃতাত্ত্বিক ছেলেমেয়েদের তাদের নিজস্ব ভাষায় পড়ালেখা শেখানোর জন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ থাকায় তা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী (২০১৩)। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে অন্তত ৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম সরকারিভাবে চালু করার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। সরকারি ও পাঁচটি ভাষাগোষ্ঠীর বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযান প্রকাশিত পহর নামে একটি নিউজ লেটারে পাঁচটি ভাষাগোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি) লেখকদের নিয়ে লেখক প্যানেল মনোনয়ন-সংক্রান্ত একটি নামের তালিকা লক্ষ্য করা গেছে। গত ২৯ জুন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের বাজেট না থাকার বিষয় উল্লেখ করেন। এ অবস্থায় ২০১৫ সালেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম সরকারিভাবে শুরু হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

তবে ৩ পার্বত্য জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পার্বত্য জেলা পরিষদের পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে ২০১০ সালে দেশের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকারের নিশ্চয়তা ও কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের আহ্বানে ন্যাশনাল এমএলই ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা বিষয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সংগঠনটির সদস্যভুক্ত হয়। মাতৃভাষায় শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রম সরকারিভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ফোরামের প্রতিনিধিরা আলোচনার মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। সমন্বয় ছাড়াও নীতিমালা ও কারিকুলাম তৈরির বিষয়ে এমএলই ফোরাম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের উদ্যোগে তিন দশকেরও বেশি সময় স্ব-স্ব ভাষায় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখার ব্যবস্থা করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আশা করে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং তাদের সন্তানদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করে দেশে বহু সংস্কৃতির সৌন্দর্য বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। নিজেরা প্রয়াস চালিয়ে সীমিত আকারে হলেও বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো, হাজং ও কোচ; উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাওন, কোলকোদা, মাহ্লে এবং বৃহত্তর সিলেটের মণিপুরি গোষ্ঠীর মানুষ নিজস্ব উদ্যোগে ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ৩ পার্বত্য জেলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিশুদের শিক্ষাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত অনেকের মনে সরকারিভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বাঁধন আরেং : লেখক, গবেষক cultural.development.cds@gmail.com

Source: http://www.jugantor.com/window/2015/02/09/218002
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment