Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

শিশুশিক্ষায় মাতৃভাষা ও আমাদের করণীয় শিশুশিক্ষা

ড. হিমেল বরকত
শিশুশিক্ষার জন্য সবচেয়ে সঙ্গত, স্বাভাবিক ও কার্যকরী মাধ্যম হলো স্ব-স্ব মাতৃভাষা। এই সত্য শিশুর ভাষাশিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা দ্বারা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই (এখানে বলে নেয়া প্রয়োজন, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা-অধ্যুষিত দেশ। এখানকার আদিবাসী শিশুদেরও নিজ-নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করা জরুরি। এ প্রসঙ্গটিও বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় কেবল বাংলাদেশের বাঙালি শিশুর ভাষাশিক্ষা-সংক্রান্ত), এদেশের সত্তর/আশি ভাগ বাঙালি শিশু গ্রামে বাস করে এবং তাদের ভাষামাধ্যম বাংলা। বাকি ত্রিশ/বিশ ভাগ বাঙালি শিশু রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে বাস করে। এদের ভাষামাধ্যমও বাংলা কিন্তু এদের অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির ফলে এসব শিশুদের ভাষাশিক্ষা যথার্থ পথে বিকশিত হচ্ছে না। শহুরে বাঙালি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ভেতর শিক্ষামাধ্যম হিসেবে বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষার প্রতি আসক্তি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে, ইংরেজি ভাষা শুধু নয়, অন্য একাধিক যেকোনো ভাষায় শিশুর দক্ষতা অর্জন অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে কোনো অবস্থাতেই তার মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়।
আমরা জানি, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনসূত্রে ইংরেজি ভাষা রাজভাষার মর্যাদা পাওয়ায় সেকালের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই খ্যাতি, ক্ষমতা, অর্থনৈতিক লিপ্সায় ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণকে শিরোধার্য করে নিয়েছিল। কিন্তু এই প্রবণতা প্রত্যক্ষ কিছু লাভ যুক্ত করলেও পরিণামে হয়ে উঠেছিল আত্মঘাতী। সেকালের ‘নববাবু’রা ইংরেজিয়ানার দাপটে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করতে শিখেছিল। বাংলা না-জানাটা তাদের কাছে পরিণত হয়েছিল গর্বের বিষয়ে। উপনিবেশিত মনের এই বিভ্রম উপলব্ধি করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লিখেছিলেন— ‘যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে’। রবীন্দ্রনাথও সেই ঔপনিবেশিক কালেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন মাতৃভাষাকে। ‘তোতা-কাহিনী’ রচনার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন ভিন্ন ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের পরিণাম আদতে মৃত্যু। শৈশবে ভিন্ন ভাষায় শিক্ষা লাভের ফলে ভাব ও ভাষার প্রকৃত সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে না। এর করুণ পরিণতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে লিখেছেন— ‘আমাদের বাল্যকালের শিক্ষায় আমরা ভাষার সহিত ভাব পাই না, আবার বয়স হইলে ঠিক তাহার বিপরীত ঘটে, যখন ভাব জুটিতে থাকে তখন ভাষা পাওয়া যায় না।’ ফলে ভাব ও ভাষার সুষম বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজন শিশুকে তার মাতৃভাষায় যথার্থ শিক্ষিত করে তোলা।
 
শিক্ষার শুরুতেই শিশুর ভাষামাধ্যম সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন বাবা-মা বা অভিভাবকদের। কেননা, পরিবারের মাধ্যমেই শিশুশিক্ষার সূচনা ঘটে। শিশুর ভাষাশিক্ষা আয়ত্তিকরণ বিষয়ে গবেষকদের মত হলো, অনুকরণের মাধ্যমে শিশুরা ভাষাকে ধাপে-ধাপে রপ্ত করে থাকে। এ কারণে পরিবারের ভেতর বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনেরা কীভাবে ও কী ভাষায় কথা বলছেন, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকেই শিশুরা আয়ত্ত করে ভাষা ও বাচনিক ভঙ্গি। এমনকি, গৃহপরিচারক/গৃহপরিচারিকার ভাষা থেকেও শিশুরা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ফলে, শিশুকে মার্জিত ও প্রমিত বাংলা শেখানোর জন্য গৃহপরিচারক/গৃহপরিচারিকাদের ভাষা-ব্যবহারেও (অন্তত শিশুর সঙ্গে ও শিশুর সামনে) সতর্ক থাকা জরুরি। পাশাপাশি, পরিবারের সদস্যরা প্রচারমাধ্যমে কোন ভাষায় খবর, নাটক, সিনেমা দেখছেন সেটাও শিশুর ভাষাশিক্ষায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আজকাল শহুরে পরিবারে বিরতিহীন হিন্দি সিরিয়াল দেখার ফলে শিশুদের হরহামেশা হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই দুর্লক্ষণ থেকে শিশুদের মুক্ত করতে পারেন। একইভাবে, শিশুর শিক্ষা ও খেলার জন্য কোন ভাষার উপকরণ (বই, সিডি, খেলনা ইত্যাদি) কেনা হবে— সে বিষয়েও বাবা-মা সচেতন থাকলে শিশুর ভাষাশিক্ষায়ও তা সহায়ক হবে। আবার, শিশুরা যেহেতু অনুকরণপ্রিয়, তাই বাড়িতে বাবা-মাকে নিয়মিত পড়াশুনা করতে দেখলে শিশুরাও পাঠের প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বাবা-মা কী ভাষায় বই-পত্রিকা পড়ছেন সেটিও শিশু লক্ষ্য করে। তাই, একটি শিশুর ভাষা-অর্জনের প্রারম্ভ থেকেই বাবা-মা-সহ পরিবারের সকলের শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষা-অর্জনের যথার্থ পরিবেশ সৃষ্টি সম্পর্কে সজাগ থাকা জরুরি। পরিবারের পরই আসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রসঙ্গ। এখন শহুরে বাবা-মা সাড়ে তিন বা চার বছর বয়সেই শিশুকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে চান। এসব কিন্ডারগার্টেন ও প্রি-স্কুলের শিক্ষকদেরও দায়িত্ব শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের বিবেচনাটিকে অগ্রাধিকার দেয়া। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুরা যেকোনো শিক্ষা যত দ্রুত হূদয়াঙ্গম করতে পারবে, অন্য কোনো ভাষাতে তা সম্ভব নয়।
শিশুশিক্ষায় আজকের দিনে আরেকটি শক্তিশালী প্রভাবক— প্রচারমাধ্যম ও প্রযুক্তি। এদেশের শহরগুলোতে খেলার মাঠ ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে। ফলে শহুরে শিশুর বিনোদন গড়ে উঠছে টেলিভিশন, কম্পিউটর, স্মার্টফোন, ভিডিও গেমস, ইন্টারনেট ঘিরে। এই প্রভাবের নেতিবাচকতায় বিচলিত না-হয়ে, একে কীভাবে শিশুশিক্ষায় ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা যায় সেদিকেই আমাদের এখন মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, কিছুদিন আগে হিন্দি ভাষায় ডাবিংকৃত জাপানি কার্টুন ‘ডোরেমন’-এর কী দুর্দান্ত প্রতাপ! এই কার্টুনের জনপ্রিয়তায় শিশুরা হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছিল এবং দৈনন্দিন জীবনে সে ভাষার প্রয়োগেও দক্ষ হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখির চাপে বাংলাদেশ সরকার ডোরেমন প্রচার স্থগিত করেছিল। যদিও বর্তমানে বাংলায় ডাবিং-কৃত ‘ডোরেমন’ প্রচারিত হচ্ছে দেশের একটি টিভি চ্যানেলে। অবশ্য বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো কিছু নিষিদ্ধ করে পার পাওয়ার উপায় নেই। ঠিকই কিন্তু ডোরেমনের আদলে তৈরি হয়েছে আরেক কার্টুন। আমার বিবেচনায়, ভিন্ন ভাষার এই আগ্রাসন রোধে নিজেদের মেধা-শক্তি নিয়োজিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমরা দেখেছি, ‘মীনা’ কার্টুনটি বাংলাদেশের শিশুরা সানন্দে গ্রহণ করেছে, যদিও এ কার্টুনে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ‘টোনাটুনি’র বিভিন্ন বই-সিডিও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে ‘সিসিমপুর’-এর নিয়মিত প্রযোজনা ও ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা এদেশের শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর সুবাতাস বলে মনে করি। বাংলা ভাষায় ও বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচের আদলে নিত্য নতুন উদ্ভাবনী আনন্দ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান মন জয় করে নিয়েছে শিশুদের। টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার ছাড়াও তারা প্রকাশ করছে শিশুশিক্ষার উপযোগী সিডি, বই, খেলার মাধ্যমে শেখার বিভিন্ন উপকরণ। শিশুর মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণার ছাপ এসব প্রকাশনায় সুস্পষ্ট। এদের নির্মিত অনুষ্ঠানগুলোও ছড়া-গান-গল্প-অভিনয়-জাদু সব মিলিয়ে সত্যিই শিশুদের আনন্দরাজ্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এনে দিচ্ছে। সবচে’ বড় কথা, এই আনন্দ উদযাপনের মধ্য দিয়ে শিশুর মাতৃভাষার শিক্ষাও যেমন সম্পন্ন হচ্ছে; তেমনি সম্পন্ন হচ্ছে বর্ণমালা, গণিত, বিজ্ঞান, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, জেন্ডারসমতা, সামাজিক আচরণ, সৃজনশীল ভাবনার প্রয়োজনীয় পাঠগ্রহণ। আমার বিশ্বাস, সিসিমপুরের এই প্রযোজনা বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে নিয়মিত প্রচার করা গেলে এবং সিসিমপুরের মতো শিশুশিক্ষামূলক আরো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলে ভিন্ন ভাষার আগ্রাসন নিয়ে আমাদের আর দুর্ভাবনায় পড়তে হবে না।
এরপর, শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করছে এমন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়েও বলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে শিশুদের নিয়ে বই প্রকাশ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু গুটিকয় ব্যতীত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের কাগজ-ছাপা অত্যন্ত নিম্নমানের। তবে, তারচেয়েও ভয়াবহ হলো— অসংখ্য ভুল বানানে সে সব বই প্রতিনিয়ত শিশুর খাদ্য হচ্ছে। শিশুরা শিখছে ভুল বানান, বইপাঠে আগ্রহ হারাচ্ছে মুদ্রণশৈলীর দীনতায়। এসব বইয়ের মান তদারকিতে সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করি। অন্যথায় প্রকাশকদের বাণিজ্যিক প্রলোভনের এই যাত্রা রুদ্ধ হবে না— যার শিকার আমাদের কোমলমতি শিশুরা।
শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম, শিশুরাই আলোকোজ্জ্বল আগামীর নির্মাতা। আগামীতে কেমন হবে আমাদের প্রিয়তম দেশ— তা নির্ধারণ করবে আজকের শিশুরাই। তাই সবার আগে প্রয়োজন এই শিশুদের যথার্থ বিকাশ, প্রকৃত শিক্ষার পথ-নির্মাণ। আমাদের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও যার-যার অবস্থান থেকে সচেতন সুদৃষ্টিই পারে মাতৃভাষায় শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনতে। আর সে প্রচেষ্টা এখনই প্রয়োজন, আমাদের স্বার্থেই।
n লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment