- সালেক খোকন
- সুদেব পাহানের বয়স তখন ছয়। বাবা খোসকা পাহানের ইচ্ছে ছেলে তার সঙ্গে কাজে যাবে। সংসারে আসবে বাড়তি আয়। কিন্ত সুদেবের মা ভারতী পাহানের স্বপ্নটা ভিন্ন। অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতোই তার ছেলে বই হাতে যাবে স্কুলে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে সুদেব। কেউ তাকে ঠকাতে পারবে না। মুন্ডা পাহানদের সম্মান বাড়বে। গোদাবাড়ীর পাহান গ্রামে আলো ছড়াবে সুদেব।
- দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গোদাবাড়ী গ্রামটিতে বিশটি মুন্ডা পাহান পরিবারের বাস। সুন্দর ভবিষ্যতের প্রলোভনে এরা ধর্মান্তরিত হয়নি এখনও। দারিদ্রের সঙ্গে নিত্যদিন সংগ্রাম করে টিকিয়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি আর সংস্কৃতিটাকে। কিন্ত সংসারে আয় না বাড়লে আসবে না সচ্ছলতা। তাই ছেলে সুদেবকে কাজে নেয়াতেই বাবার আগ্রহ বেশি। গোদাবাড়ীর মুন্ডা পাহানরা কথা বলে সাদরি ভাষায়। এ ভাষাতেই মায়ের ঘুম পাড়ানি গান আর বাবার বকুনি খেয়েই বেড়ে উঠেছে সুদেব। রাত-দিন মায়ের কথায় আর উৎসব-আনন্দে আদিবাসী গানে সুদেবের আলিঙ্গন হয়েছে তার প্রিয় মায়ের ভাষাটির সঙ্গে।স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্যের এক পর্যায়ে সুদেবকে স্কুলে পাঠাতে সম্মতি দেন খোসকা পাহান। বুক ভরা আশা নিয়ে তারা সুদেবকে ভর্তি করায় স্থানীয় কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই দুরন্ত সুদেবের শিশুমনে ছন্দপতন ঘটে। তার মন থেকে আনন্দ-হাসি উবে গিয়ে জায়গা করে নেয় এক অজানা আতঙ্ক। সুদেব হেসে খেলে বড় হচ্ছিল যে ভাষার আলিঙ্গনে। মায়ের সে ভাষাটিকে সে খুঁজে পায়না বিদ্যালয়ে। সেখানে প্রচলন নেই তার আদিবাসী ভাষাটির। কেউ কথাও বলে না তার প্রিয় সাদরি ভাষায়। চারপাশের সকলেই বাংলা ভাষাভাষি। বাংলা তার কাছে অপরিচিত, অন্য জাতির ভাষা। ফলে শিক্ষালাভ করতে এসে শিশু বয়সেই বাংলা ভাষাটি তার ওপর আরোপিত হয়।
এভাবেই চলতে থাকল কিছুদিন। একেতো ভাষার ভীতি তার ওপর ক্লাসের বন্ধুদের আচরণে সুদেব একেবারেই মুষড়ে পড়ে। আদিবাসী বলে তাকে বসতে হয় আলাদা এক বেঞ্চিতে। কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না। অন্যেরা সবাই তাকে আড়চোখে দেখে। তাই তার ভাব বিনিময়ের পথও হয় রুদ্ধ। লেখাপড়া না জানায় সুদেবের বাবা-মায়ের পক্ষেও সম্ভব হয় না সুদেবকে সাহায্য করা। ফলে এক অজানা আতঙ্ক ক্রমেই তার মনে বাসা বাঁধে। দিনে দিনে স্কুলে যাওয়া তার কাছে রীতিমতো ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রথম পরীক্ষাতেই ফেল করে সে। বিদ্যালয়ের দুর্বল ছাত্রের তালিকায় নাম ওঠে সুদেবের। কেউ জানতেও পারে না সুদেবের এই পিছিয়ে পড়ার কারণটি। এভাবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুদেব হারিয়ে ফেলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহটি। পড়াশুনায় ইতি টেনে শিশু বয়সেই শুরু হয় সুদেবের কাজে যাওয়া।দিনাজপুরে সীমান্তবর্তী আরেকটি গ্রাম হালজায়। এই গ্রামে কড়া সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বাস। গোটাদেশে কড়ারা টিকে আছে মাত্র ১৯ টি পরিবার। হারিয়ে যাচ্ছে কড়ারা। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস। কড়া পাড়ার শিতা কড়া আর কোলো কড়ার আদরের সন্তান কৃষ্ণ কড়া। শিশু বয়সেই কৃষ্ণ কড়া ভর্তি হয় নিকটবর্তী রাঙ্গন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে প্রথমদিনেই কৃষ্ণ যেন সাগরে পড়ে। তার মায়ের কড়া ভাষায় বিদ্যালয়ে কেউ কথা বলে না। বন্ধুরা সকলেই বাঙালি। জাত যাওয়ার ভয়ে কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে সকলেই। অবজ্ঞা আর অবহেলায় কষ্ট পায় কৃষ্ণ। কিন্ত মায়ের উৎসাহে সাহস হারায় না। ফলে এক বেঞ্চিতে বন্ধুবিহীন একাই কাটিয়ে দেয় সে। অজানা বাংলাভাষা বুঝে পরীক্ষায় পাশ করা- সে এক দুরূহ ব্যাপার! তাই পাশ ফেলের মধ্যেই কেটে যায় তার ৫টি ক্লাস।হালুয়াঘাটের এক গারো নারী সুমনা চিসিম। পেশায় একজন এনজিও কর্মকর্তা। পড়াশোনা শুরু করেন নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরি মিশন স্কুলে। প্রথম স্কুলে গিয়ে সেসময় সুমনাও খুঁজে পাননি নিজের মায়ের ভাষাটিকে। ফলে প্রথম দিনেই ভড়কে যান তিনি। সুমনার ভাষায় ‘আমার ক্লাস টিচার ছিলেন একজন বাঙালি। স্বভাবতই আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে, ভাষা বুঝতে না পারায় সঠিক উত্তর দিতে পারতাম না। বাঙালি ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করত। আমি বুঝতাম না কেন তারা হাসে। টিচারদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম। তুমি ও আপনির ব্যবহার জানা ছিল না তখন। প্রথম প্রথম বাংলাভাষা না জানার কারণে নিজেও ছিলাম অন্ধকারে।’ওপরের চিত্রগুলোতে এদেশে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষালাভের বাস্তব অবস্থা খানিকটা প্রকাশ পায়। কিন্তু সার্বিকভাবে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের চিত্র আরও করুণ। ভাষা শুধু প্রকাশমাধ্যমই নয়, বরং ভাষা প্রকাশের বিষয়কে নতুন রূপ দিয়ে অর্থবহ করে তোলে। তাই শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকায় প্রধান। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের দুধের মতো। নিজেকে প্রকাশে মাতৃভাষা দেয় সকালে সূর্যের দিগন্ত বিস্তারী আলো।’ কিন্ত এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী শিশুদের জন্য নেই কোন আদিবাসী ভাষায় পুস্তক কিংবা আদিবাসী ভাষাভাষি কোন শিক্ষক। ফলে আদিবাসী শিশুরা নিঃশব্দে বঞ্চিত হচ্ছে মাতৃভাষার সেই দিগন্ত বিস্তারী আলো থেকে।শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। এই ভাষাই যদি শিশুর কাছে হয় দুর্বোধ্য আর ভীতিকর তবে প্রথমেই শিশুর মানসিক ও মানবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। এদেশে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার শুরুতেই বোঝার মতো চেপে বসেছে বাংলাভাষাটি। ফলে বিকশিত না হয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে আদিবাসী শিশুদের স্বপ্নগুলো। রাষ্ট্রীয় নিয়মেই আদিবাসী শিশুদের কোমল মনে বাংলা ভাষার কষাঘাত বাংলা ভাষাটিকে আগ্রাসী ভাষা হিসেবে মনে হওয়াও যুক্তিসংগত হয়ে উঠেছে। বাঙালি সমাজের কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার শুরুতেই বিদ্যালয়ে আনন্দ-হাসির মধ্যে নিজের মাতৃভাষায় ছড়া কাটছে, নিজের ভাষায় ভাব জমিয়ে বন্ধুত্ব করছে অন্য শিশুদের সঙ্গে তখন আদিবাসী শিশুরা নীরবে, নিস্তব্ধে চোখের জল ফেলে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয় থেকে। এমন দৃশ্য যেকোন বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেবে।কিন্ত এদেশের মানুষই তো মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত করেছিল নিজের বর্ণমালাগুলোকে। বাঙালি জাতির সে ইতিহাস আজ গোটা বিশ্বের জানা। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট ভাষা। ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদ জানায়। দ্রুত সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র বিক্ষোভে গুলি চালায় পুলিশ। শহীদ হন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার। পূর্ব পাকিস্তান নামে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হয় একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।বাংলাদেশের অনুরোধে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ২৩ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।সালেক খোকন : লেখক, গবেষক।
(চলবে) - Source: http://www.poriborton.com/poriborton-opinion-news/8327-2016-02-05-10-38-34
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment