আনওয়ারুল ইসলাম রাজু
“নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা ”
ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান। আর এক্ষত্রে মাতৃভাষা হলো এই উদ্দেশ্য সাধনের সবচেয়ে মাধ্যম।
মানুষের জন্ম ও বিকাশের সাথে তার মাতৃভাষার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। শিশু এই
পৃথিবীতে এসে প্রথম যেই ভাষার, যেই ধ্বনির সাথে পরিচিত হয় তা তার মাতৃভাষা
হতেই আসে, সবচেয়ে ভালোবাসা আর উষ্ণতা লাভ করে যে মায়ের কাছ থেকে তার ভাষাই
তার আপন হয়ে ওঠে অনেক বেশি। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি আর ধর্মে
সমৃদ্ধ বৈচিত্রপূর্ণ একটি দেশ, আমাদের এই বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই
দেশের পার্বত্য এলাকাসহ সমতল অঞ্চলে মুল জনজাতি ধারা বাঙালির পাশাপাশি
বসবাস আরও অন্তত ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। এদের
জনসংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.১০ শতাংশ। এদের
মধ্যে- চাকমা, মারমা , ত্রিপুরা, মুরং, রাখাইন, গাড়ো, হাজং, খাসিয়া,
মণিপুরী, সাঁওতাল, ওরাঁও, মু-া ইত্যাদি প্রধান। এদের প্রত্যেকের রয়েছে
নিজস্ব মাতৃভাষা ও বিশেষ বৈশিষ্টম-িত নিজস্ব সংস্কৃতি । কিন্তু মাতৃভাষার
অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে যে দেশের মানুষ, সেই দেশে বসবাসকারী
এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলো আজও যথাযথ মর্যাদা পায়নি। প্রয়োজনীয়
পৃষ্ঠপোষকতা ও চর্চার অভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন
পর্যন্ত সরকারিভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীয় ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ
নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে কোচ ও রাজবংশীদের ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
প্রায় পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে কুরুখ ও নাগরি ভাষা।
এ অবস্থা শুধু আমাদের দেশেই নয়;সারা পৃথিবী জুড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীয়
ভাষাগুরো আজ চরম হুমকির মখে রয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রতি
দুই সপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। বিলুপ্তপ্রায় এসব ভাষা রক্ষার
ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেছে ইউনেস্কো। এ ভাষাগুলো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলে
তা মানবজাতির জন্য হবে বিপর্যয়কর ও দুর্ভাগ্যজনক। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের
আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়টি অতি দ্রুত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা
করা উচিত।
গবেষকদের মতে আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষায় শিক্ষার অভাব,
নিজস্ব বর্ণমালা ও শক্তিশালী সংগঠন না থাকা এবং জনসংখ্যা হ্রাস,
সংস্কৃতিচর্চার অভাব ও সমপ্রদায়গুলোর আর্থিক দুরবস্থার কারণে তাদের
মাতৃভাষা ক্রমেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে
বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা আলোর মুখ
দেখছে না। আদিবাসী বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্মন জনগোষ্ঠীর ‘বর্মন’ ভাষা, মাহাত
সমপ্রদায়ের ‘মাহাত’ ভাষা এক রকম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তাদের দুটি
ভাষা হারিয়ে গেছে, প্রায় মরে যেতে বসেছে পাহাড়িয়া, মুসাহর, কোচ, হাজং,
তুরী, বাগদি প্রভৃতি ভাষাসহ অন্তত আরও ১০টি ভাষা।
জাতিগতভাবে পাংখো, খেয়াং, কুমি আছে প্রান্তিক পর্যায়ে। কোচ সম্প্রদায়ের
ভাষা এখন দু-একজন বয়স্ক ছাড়া কেউ জানে না। নতুন প্রজন্ম কথা বলে বাংলা বা
চাকমা ভাষায়। উরাও জাতির প্রায় ২ লাখ লোকের মধ্যে বড়জোর ১৫ হাজার লোক
নিজেদের ‘কুরখ’ ভাষায় কথা বলতে পারে। বাকিরা কথা বলে সাদ্রী ভাষায়।
মাতৃভাষার স্বীকৃতি না থাকায় বাধ্য হয়ে ক্ষুদ্র্র এসব জনগোষ্ঠী ঝুঁকে পড়ছে
বাংলা, চাকমা, মারমা কিংবা অন্য ভাষার দিকে। গবেষকদের মতে, আর্থিক
দুরবস্থার কারণে আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলো তাদের ভাষা ধরে রাখতে পারছে
না। পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলোকে উন্নত সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে
পূর্বপুরুষের বসতভিটা থেকে নিয়ে আসা হয় অন্য জায়গায়। এতে ভিন্ন ভাষাভাষী
মানুষের সংস্পর্শে এসে পশ্চাৎপদ জাতির লোকজন ভুলে যাচ্ছে তাদের মায়ের
ভাষা।নিজ জাতির বাইরে গেলেই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বাংলা কিংবা চাকমা-মারমা
ভাষায় কথা বলা ছাড়া উপায় থাকে না। যেমন চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা এবং মারমা ও
রাখাইনরা একই ভাষায় কথা বলে। সাদ্রী ভাষা ব্যবহার করছে প্রায় ১০টি
জনগোষ্ঠী। একইভাবে আরো কয়েকটি সম্প্রদায় আছে যাদের জাতিগত ভিন্নতা থাকলেও
মুখের ভাষা এক। কিন্তু চাকমা ও মারমা ছাড়া আর কারো বর্ণমালা নেই। প্রকৃত
নিজস্ব বর্ণ আছে চাকমাদের। মারমারা ব্যবহার করে বার্মিজ বর্ণ। নিজস্ব
বর্ণমালা না থাকায় অন্য গোষ্ঠীগুলো রোমান বা বাংলা বর্ণে তাদের ভাষা লিখে
থাকে।
ভাষা আন্দোলনের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত এই দেশে
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ তাদের তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় লেখাপড়ার অধিকার
থেকে আজও বঞ্চিত হচ্ছে। আদিবাসী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের
লেখা-পড়া শিখতে হয় সম্পূর্ণ অপরিচিত ভাষা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় । ক্ষুদ্র
নৃগোষ্ঠীর শিশুরা যখন নতুন ভর্তি হয় তখন তারা যে ভাষা-অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে তা
তাদের পরিবার ও সমাজের প্রচলিত ভাষা, যা তার পাঠ্য বইয়ের ভাষা বা পাঠদান
মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ভাষা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার কারণে আদিবাসী শিশুরা
পাঠের বিষয়বস্তুর সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং যে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন
করার কথা তা করতে পারে না। ফলে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবার পর আরো বেশী
অসহায় হয়ে পড়ে। ভাষা সমস্যার কারণে আদিবাসী শিশুদের লেখা-পড়াতো পরের কথা,
স্কুলে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে প্রয়োজনীয় ভাবের আদান-প্রদানও তাদের
জন্য কঠিন হয়ে পরে। এক গবেষণা জরিপ রিপোর্টে জানা গেছে, স্কুলে গিয়ে অনেক
সময় আদিবাসী শিশুরা প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে যাওয়ার কথাটিও
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঠিকমত বুঝাতে না পেরে শ্রেণিকক্ষেই মলমূত্র ত্যাগ করে
ফেলে।
মুলত ভাষা বেঁচে থাকে চর্চার মধ্যদিয়ে। যথাযথ চর্চার অভাবে আদিবাসী
ভাষাগুলো আজ কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে, পাশাপাশি লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ার
পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে।
ভাষা শুধুমাত্র ভাব প্রকাশ মাধ্যমই নয়, বরং ভাষা প্রকাশের বিষয়কে নতুন রূপ
দিয়ে অর্থবহ করে তোলে। তাই শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকাই প্রধান।
কিন্তু এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীয় শিশুদের জন্য
নেই কোনো মাতৃভাষায় বই-পুস্তক কিংবা তাদের ভাষাভাষী কোন শিক্ষক। অতি
সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি এখনও আলোর মুখ
দেখেনি। ফলে আদিবাসী শিশুরা নিঃশব্দে বঞ্চিত হচ্ছে মাতৃভাষার দিগন্ত
বিস্তারী আলো থেকে।
বাঙালি সমাজের কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার শুরুতেই বিদ্যালয়ে আনন্দ-হাসির
মধ্যে নিজের মাতৃভাষায় ছড়া কাটছে, নিজের ভাষায় ভাব জমিয়ে বন্ধুত্ব করছে
অন্য শিশুদের সঙ্গে তখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীয় শিশুরা নীরবে, নিস্তব্ধে চোখের
জল ফেলে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয় থেকে। এমন দৃশ্য যেকোনো বিবেকবান
মানুষকে নাড়া দেবে।
আমাদের দেশে সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ককরার হয়েছে। অথচ
মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশু স্কুলে যায়। যাদের মধ্যে বড় একটি
অংশ মাতৃভাষার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ঝরে পড়ে। তাই প্রয়োজন নৃগোষ্ঠীর
ভাষাগুলো রক্ষার পাশাপাশি শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, এলাকায় বিদ্যালয়
স্থাপন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীয় শিক্ষক নিয়োগ প্রভৃতি। এ বিষয়ে সরকারের
উদ্যোগগুলোরও দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতেই নয়, সব
সময়ই আমরা চাই- রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার গৌরবময় ইতিহাসের
উত্তরাধিকারীদের এ দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা পড়ুক তাদের চিরচেনা মায়ের
ভাষায়।
মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির আত্মদানের দিনটি আজ সারা বিশ্বে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস মূলত সকল জনগোষ্ঠির মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বলে ।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।
উপদেষ্টা সম্পাদক, উত্তরবাংলা ডট কম।
Source: http://www.uttorbangla.com/?p=60886
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment