Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দান

গৌরব জি. পাথাং
ফেব্রুয়ারি হলো ভাষার মাস। বাঙালী একমাত্র জাতি, যে জাতি ভাষার জন্য লড়াই করেছে এবং জীবন উৎসর্গ করেছে। তাই সেই সংগ্রামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইউনেস্কো ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নবেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় । এই দিনটি আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের এবং আনন্দের দিন। কারণ বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টির অধিক ভাষা আছে। সেসব ভাষায় মানুষ কথা বলে। এ ভাষাগুলো বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তবে হতাশার কথা হলো, অদ্যাবধি এই ভাষাগুলো জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় পাঠ্যপুস্তকে স্থান পায়নি। এ ভাষাগুলো ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার বাহন হয়ে ওঠেনি। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনের এতদিন পরেও তাদের ভাষাগুলো শিক্ষার বাহন এবং তাদের কৃষ্টি সংস্কতিগুলো শিক্ষার উপকরণ হয়ে ওঠেনি। তাই মাতৃভাষার শিশু শিক্ষা দানের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মাতৃভাষা হলো শিশু শিক্ষার প্রধান বাহন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রারম্ভেই শিশুকে রাষ্টীয় ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষায় কথা বলতে, লিখতে ও বুঝতে সক্ষম করা তোলা হয়। মাতৃভাষা ব্যতীত কোন শিশুই শিক্ষার প্রকৃত রস আস্বাদন করতে পারে না। মাতৃভাষাকে সেই জন্য মাতৃস্তনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মাতৃস্তন ব্যতীত যেমন একটি শিশু পরিপূর্ণ পুষ্টি ও সুষম বৃদ্ধি লাভ করে না, তেমনি মাতৃভাষা ব্যতীত কোন শিশু শিক্ষার প্রকৃত রস পায় না। তাই অনেকে অকালেই ঝরে যায়। মাতৃভাষায় শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় শহর, গ্রাম ও দুর্গম এলাকার শিশুরা অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ে। তার মধ্যে দুটি সমস্যা উল্লেখযোগ্য।
প্রথম সমস্যা হলো নিজের মাতৃভাষা বা জাতিগত ভাষা ভুলে যাওয়া। কিছু কিছু এলাকার শিশুরা নিজের মাতৃভাষাই ভুলে যাচ্ছে। এই শিশুরা হলো যারা অন্য জাতি-গোষ্ঠীর লোকের সঙ্গে বেশি চলাফেরা করে, যারা শহরে থেকে লেখাপড়া করে; যাদের বাবা-মা চাকরি করতে গিয়ে শহরে থাকে। যারা শিশুদের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলে না এবং শিশুদেরকেও উৎসাহ দেয় না। আজ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে কোন দ্বিধা নেই। আমি যখন টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থানার কয়েকটি গ্রাম ঘুরেছি এবং ময়মনসিংহের কয়েকটি গ্রামে থেকেছি, তখন সেই করুণ পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছি। মধুপুরের জলছত্র, পিরোজপুর, জাঙ্গালিয়া, মাগন্তীনগর, চাপাইদ এবং ময়মনসিংহের ঢাকুয়া, হুগলা এসব গ্রামের গারো উপজাতির ছোট শিশুরা নিজেদের মধ্যেও মাতৃভাষায় কথা বলে না। আমি দেখেছি মাতৃভাষায় তাদের কি দৈন্য! গ্রামে গিয়ে গারো ভাষায় যখন প্রশ্ন করতাম নাংনি বিমুং মো? নাম্মে দং-ঙা? (তোমার নাম কি? ভাল আছ?) তখন তারা কিছুই বলত না। আর আমি যদি বাংলায় প্রশ্ন করতাম তবে উত্তর পেতাম। সেই অবস্থা শুধু গ্রামে নয়, শহরেও বিদ্যমান। মা-বাবার উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে শিশুরা মাতৃভাষা চর্চা করার সুযোগ পায় না। বাবা-মা চান শিশুরা শুধু যেন বাংলা কিংবা ইংরেজি শেখে। তারা তাতে গর্ববোধ করেন। তাই শিশুরা মাতৃভাষার রস আস্বাদন করতে পারে না।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো সিলেট, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় শিশুরা বাংলা ভাষা জানে না। তাতে স্কুলে গেলে তারা স্বাভাবিক হতে পারে না। স্কুলের পরিবেশ তাদের কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। তারা হয়ে যায় ডাঙায় তোলা মাছের মতো। শিশুরা ঘরে যে ভাষা পায়, স্কুলে সে ভাষা পায় না। তাই তাদের নিকট বাংলা ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করা কঠিন হয়ে যায়। মৌলভীবাজার জেলার কয়েকটি খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। খাসিয়াদের আবাস্থল সাধারণত লোকালয় থেকে অনেক দূরে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় হয়ে থাকে। পান চাষের সুবিধার জন্যই তাদের এত দূরে গিয়ে বসবাস করতে হয়। লোকালয় থেকে অনেক দূরে বলে তারা অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায় না। সে জন্য তারা বাংলা ভাষায় এতটা পারদর্শী নয়। এই পরিবেশে একজন খাসিয়া শিশু কিভাবে মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় শিক্ষা লাভ করবে? কিভাবে শিক্ষার রস আস্বাদন করবে? তাই সেখানে প্রয়োজন বাংলা ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষার শিক্ষা দান করা। তাতে শিশুরা আরও বেশি জ্ঞানার্জন করতে পারবে। সে কারণেই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি...”।
আমাদের দেশে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মাতৃভাষার শিশুশিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক নেই, পাঠ্যক্রম নেই, তাদের শিক্ষার উপকরণ ও বিষয়াদি তাদের জীবন থেকে আলাদা। আদিবাসী শিশুশিক্ষার উপকরণের সঙ্গে শিশুর বাস্তবতার সামঞ্জস্য না থাকার কারণে শিক্ষার বিষয়বস্তু তাদের নিকট সহজবোধ্য হয় না। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, একজন বাঙালীর শিশু বাউল ও একতারার বর্ণনা যত সহজে দিতে পারবে একজন আদিবাসী শিশু তা সহজে পারবে না। তার চেয়ে একজন গারো শিশুর কাছে তার কৃষ্টি সংস্কৃতির রাং, দামা, দকমান্দার বর্ণনা দেয়া অনেক সহজ।
বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউনেস্কো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রভৃতি মাতৃভাষার খুবই জোর দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার অনুচ্ছেদ ২৩ এর ১ ও ২-এ বলা হয়েছে যে, “সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর শিশুদেরকে তাদের মাতৃভাষায় পড়া ও লেখার জন্য শিক্ষাদান করতে হবে কিংবা যেখানে এটা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষাতেই সে শিক্ষা দিতে প্রদান করতে হবে।” আরও লেখা আছে যে, “মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা কিংবা দেশের অফিসিয়াল ভাষার ক্রমান্বয়ে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে হইলে, ব্যাপক করিত হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়।” আমরা মাতৃভাষা ব্যতীত অনেক কিছুই লাভ করতে পারি, কিন্তু সে লাভ ভাষাকে পূর্ণতা দেবে না। আমরা চিন্তা করতে পারি, কিন্তু সে চিন্তার বাইরে আমাদের ভাষা পড়ে থাকবে। তাই একজন বাঙালীকে তার বাংলা ভাষা, একজন গারোকে তার আচিক ভাষা, একজন চাকমাকে তার ককবরক কিংবা সাঁওতাল, উঁরাও, খাসিয়া, ত্রিপুরা তাদেরকেও তাদের নিজস্ব ভাষা শিখতে দেয়া উচিত।
আমরা যারা আদিবাসী আমাদেরও মাতৃভাষা শিক্ষা, অনুশীলনী ও সমৃদ্ধির জন্য নিজেদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। মাতৃভাষা উৎকর্ষের জন্য নিজেদের মধ্যেই ভাষাবিদ ও গবেষক হতে হবে, ভাষার সমৃদ্ধির জন্য একাডেমী বই, অভিধান ইত্যাদি প্রস্তুত করা দরকার। সে জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের পিতা-মাতা ও পরিবারের মধ্যে শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। পরিবারে মাতৃভাষায় কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তবেই মাতৃভাষা সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।
সবশেষে ডা. লুৎফর রহমানের কথা দিয়ে লেখা সমাপ্ত করতে চাই। তিনি বলেছেন, “শিশু বয়স হইতে কত সুখ ও দুঃখের কথা, কত স্নেহ মায়ার প্রকাশ, কত প্রার্থনা, কত পরিচিত প্রাণ, কত হাসি, কত হারানো কণ্ঠস্বর সে ভাষার সহিত জড়াইয়া আছে, তাহা কি ভোলা যায়? তাহা ভুলিলে আমার যে আর কিছুই থাকে না। আমি ভিখারি হইতে পারি, দুঃখ আশ্রয়ে কঠিনভারে চূর্ণ হইতে আপত্তি নাই। আমি মাতৃহারা অনাথ বালক হইতে পারিব কিন্তু আমার শেষ সম্বল মাতৃভাষাকে ত্যাগ করিতে পারি না। আমার ভাষা চুরি করিয়া আমার সর্বস্ব হরণ করিও না।” তার এই কথা যেন আজ আমাদের প্রাণের কথা। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, যে ভাষায় সুখ-দুঃখ প্রকাশ করি, গান করি, নাচ করি সে ভাষায় কেন লেখাপড়া করতে পারব না? তাই আজ তার মতো আমরাও বলতে চাই, আমাদেরকে আমাদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করবেন না। আমাদের মাতৃভাষা হরণ করবেন না।
Source: http://oldsite.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=13&dd=2013-02-26&ni=126862
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment