রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার
স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেখানে আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে
সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করার কথা
বলা হয়েছে। এতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণের
ব্যাপারে আশান্বিত হয়েছিলেন। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৪ সাল
থেকে যে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু হয়েছে, সেখানে
বিভিন্ন ভাষার আদিবাসী শিশুদের শুধু তাদের ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে
শিক্ষার সুযোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে সরকার কার্যক্রমও হাতে নিয়েছিল।
কিন্তু ২০১৫ পেরিয়ে ২০১৬ সালেও সরকারের সে প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন
ঘটেনি, যা খুবই হতাশার।
এটা এখন সর্বজন স্বীকৃত যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শুরু হওয়াই শিশুর
মেধা বিকাশের সবচেয়ে সহায়। শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের পর্যবেক্ষণেও দেখা গেছে,
মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ।
অথচ এ দেশে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী ২০ লাখেরও বেশি মানুষ মাতৃভাষায়
শিক্ষালাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে আদিবাসীদের মাতৃভাষার কোনো
প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। পার্বত্য চুক্তির খ খণ্ডের ৩৩ নম্বর
ক্রমিকের খ (২) নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে
মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ থাকায় বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ভাষাভাষীর
মাতৃৃভাষা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু সেই চুক্তির একযুগের
মধ্যেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। গত ২০১০ সালে
যে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়, সেখানে এ দেশের আদিবাসী তথা সরকারি
ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহ
অন্তর্ভুক্ত হয়। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের শুরুতেই প্রাথমিক ও
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের জন্য
মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির। এ বিষয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক
পদক্ষেপ হিসেবে ২০১২ সালে গঠিত হয় একটি জাতীয় কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশে
প্রাথমিকভাবে ছয়টি (চাকমা, মারমা, ককবোরক, মান্দি, সাঁওতালি ও সাদরি) ভাষায়
পাঠ্যপুস্তক তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়।
এর মাঝে লিপির প্রশ্নে সাঁওতাল সম্প্রদায় এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায়
সাঁওতালি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরির বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখা হয়। সূচনাবর্ষে
(২০১৪ বা ২০১৫) পাঁচটি আদিবাসী ভাষা এবং পরবর্তী বর্ষে আরো কিছু ভাষা
এভাবে ক্রমান্বয়ে সম্ভাব্য সব আদিবাসীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা
থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু সে
প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। স্বাভাবিক কারণেই তা
আদিবাসীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করছে। আমরা লক্ষ্য করছি আদিবাসী
বিভিন্ন সংগঠন এ দাবিতে ধর্মঘটের মতো কর্মসূচিও পালন করছেন।
উল্লেখ করা দরকার যে, সরকারি উদ্যোগের অনুপস্থিতিতেও কিছু এনজিও এ
ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা,
মারমা, মণিপুরী ও ম্রোদের নিজস্ব লিপি আছে, যা দ্বারা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে
উন্নয়ন সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা
কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো সরকারি উদ্যোগ ছাড়া বৃহত্তর
পরিসরে এই কাজটি সুচারুভাবে করা সম্ভব নয়। এনজিওর এ যাবৎকালের কার্যক্রম
সরকারি উদ্যোগে সহয়ক হিসেবে কাজ করারই কথা। পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও
শিক্ষানীতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক
শিক্ষার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এটি বাস্তবায়নে
দীর্ঘসূত্রতা অনুচিত। ইতোমধ্যে অনেকটা সময়ক্ষেপণ হয়ে গেছে। আমরা আশা করি,
সংশ্লিষ্টরা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এ কাজটি দ্রুত বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবেন,
আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক কোনো জটিলতা যেন এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়।
উৎস: http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/02/14/75405.php
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment