January 5, 2016
দেশের নারী চা-শ্রমিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখান।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের মুক্তি যোদ্ধা হিরামনি সাঁওতাল দেশের জন্যে লড়েছেন,
শুধু হিরামনি নয়, ১৯৭১ সালে জান বাজি রেখে লড়েছিলো চান্দপুরের অনেক চা
শ্রমিক। সেই লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে ছিলেন হিরামনি আর আছে চান্দ পুরের
গণকবর।স্বাধীনতার জন্যে কেউবা হারিয়েছেন সম্ব্রম, সম্ভ্রম হারানো নারীদের
মধ্যে বেশির ভাগেরই হয়েছে মৃত্যু, যারা ছিলেন তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা
হিরামনি সাঁওতাল একজন।
ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেছেন, আমরা বিজয়ের কথা বলি কিন্তু
নির্যাতনের কথা বেশি প্রচার করতে চাইনা, তিনি আরো বলতে চেয়েছেন যে
বাংলাদেশের যত গণকবর আছে,যত বধ্য ভূমি আছে সকল কিছু সং রক্ষণ করে যেতে
হবে,প্রকাশ করে যেতে হবে মাত্র ৯ মাসে কত বীভত্স ভাবে হত্যা,নিপীড়ন আর
ধর্ষণ চলেছিল, তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করতে পারব,
পাকিস্তান কে চিনতে পারব !
৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডা.জিওফ্রে ডেভিস দেশজুড়ে তার চিকিৎসা
কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং জেলায় চালানো নমুনা জরিপের মাধ্যমে
পরিসংখ্যান তৈরি করে জানান, ৪ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার নারী মুক্তিযুদ্ধে
ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।সামান্য উদাহরণ দিলে উঠে আসবে সমগ্র দেশের ভয়াবহতা,
সাংবাদিক রণেশ মৈত্রের এক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়,রংপুর ক্যান্টনমেন্ট
এবং আর্টস কাউন্সিল ভবনটি নারী নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হত। এখানে
বন্দী ছিল প্রায় একশ মেয়ে এবং প্রতিদিনই চলত নির্যাতন,যারা অসুস্থ হয়ে
পড়ত তাদের হত্যা করা হত সাথে সাথেই।যশোর ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকা
হারেছউদ্দিনের ভাষ্যে জানা যায় ক্যান্টনমেন্টে ১২ থেকে ৫০ বছর বয়সের ২৯৫
জন মেয়েকে আটক রাখা হয়েছিল,তাদের উপর নির্যা তন চলত প্রতি রাতেই অনেকবার
নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কম যায়নি বিহারীরাও।এরকম যৌনদাসীর শিকার হয়েছেন
হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগানের অনেক শ্রমিক ।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য ত্যাগী বীরাঙ্গনা হীরামনি সাঁওতালসহ ৬ জন নারীর সন্ধান
পান কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর কন্যা বর্তমানে এমপি কেয়া চৌধুরী । ২০০৬
সালে তিনি ৬ জন নারীর মুক্তিযোদ্ধার অধি কার আদায়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৯
সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে ২০১২/ ৯ ডিসেম্বর, ৬ জন
বীরনারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত করার কাজটি সম্পন্ন করতে
পারেন।স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন ফারিজা খাতুন, মালতি রানি,
শুক্ল বৈদ্য, পুস্পরাণী শুক্লবৈদ্য, রাজিয়া খাতুন, হীরামনি সাওতাল ও
সাবেত্রী নায়েক।
এখানে উল্লেখ করে রাখি, এরকম ই একজন মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনার কথা আমরা
লিখেছিলাম, ১৭ ডিসে ম্বর, ২০১৫ সালে, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার পূর্ব
নবাইদ গ্রামের রাজিয়া বেগম কমলা বয়স ৬০ বছর।দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে বীরাঙ্গনারা
যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন শেখ হাসিনার সরকার।অবশেষে
বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছেন সরকার।
রাজিয়া বেগম কমলারও সাধ ছিল মরার আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নাম টা দেখার !
কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি ! কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেহেদি হাসান
কমলার নাম তুলতে মূল্য বাবদ দাবি করেন ২ লাখ টাকা।প্রথম আলো একবার সংবর্ধনা
সমেত রাজিয়া বেগম কমলাকে কিছু টাকা দেয়, ওই টাকা আর বাকি ধার-দেনা করে ২০
হাজার টাকা দিলেও পুরো টাকা না দিতে পারায় ওই তালি কায় এখনো নাম উঠেনি এ
বীরাঙ্গনার,, মেলেনি মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ জেলা
শহরে পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকার আবাসন পল্লীতে সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার
ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সম্পাদক আব্দুর রবের অফিসে ফাইফরমাস খাটেন,
আমরা যোগাযোগ করলে আব্দুর রব বলেন,নিয়মানুযায়ী কিশোর গঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা
সংসদকে নাম নিবন্ধন করতে হবে, তিনি বলেন কমলা আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে জাতিসংঘে সভা করতে গিয়েছিলেন কম্বোডিয়া, তারপরেও কেউ
সাহায্য করলো না মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার নাম গেজেটভুক্ত করতে। আমাদের সাথে
যোগাযোগ করেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের ছাত্রলীগের একজন নেতা, ময়মনসিংহ থেকে
নিয়ে এসে নাম নিবন্ধন করার আশ্বাস দেন, কয়েকদিন আশ্বাস দিয়ে তিনি আর
আমাদের ফোন ওঠালেন না ! সিলেটের কেয়া চৌধুরীর মত কেউ কমলার ভাগ্যে নাই,
কিন্তু আমরা জানি কমলা মারা গেলে তার নাম এ সভা হবে – ফুলের স্তুপ জমবে !
আজ যেমন আমরা লিখছি হিরামনির কথা ! এম পি কেয়া চৌধুরীকে শুভেচ্ছা, আমরা
কৃতজ্ঞ।হীরা মনি সাঁওতাল ৩ মার্চ বৃহস্পতিবার ভোর নিজ ঘরে মারা যান।এ সংবাদ
জানার পরই হীরামনির বাড়িতে ছুঁটে যান এমপি কেয়া চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা
রাজিয়া খাতুন, সাবিত্রী নায়েক সহ বিভিন্ন স্তরের লোকেরা। কেয়া চৌধুরী সকল
ব্যবস্থা করেন।পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশের প্রথম নারী চা-শ্রমিক মুক্তি
যোদ্ধা হীরামনি সাঁওতালকে সমাহিত করা হয় । হীরামনির জন্ম মৌলভীবাজার জেলার
শ্রীমঙ্গল উপ জেলার হুগলি ছড়া চা বাগানে।বাবার নাম অর্জুন সাঁওতাল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রায় ২ মাস পূর্বে তার বিয়ে হয় হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট
উপজেলার চান্দপুর চা বাগানের চৌকিদার লক্ষণ সাঁওতালের সঙ্গে।স্বামী লক্ষণ
সাঁওতাল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্ত্রীর পাশে ছিলেন, ধর্ষণে অন্ত স্বত্তা কে
ছেড়ে যান নাই, স্ত্রীর পুত্র সন্তান হলে তাকেও লক্ষণ নিজের ছেলেমেয়ের সাথে
মানুষ করেন । ছেলে বড় হতে হতে বাগানের মানুষের কাছ থেকে নিজের জন্ম
বৃত্তান্ত জেনে ক্ষুব্ধ হয়ে বেছে নেয় নেশা ও মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যায়,
বৃদ্ধ লক্ষণ সাঁওতালও জীবনের শেষলগ্নে এসে উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুশোক
সইতে পারলেন না।কিছুদিনের মধ্যে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।লক্ষণ সাঁওতালের
মৃত্যুতে দুই মেয়ে সহজ মনি ও সজনীকে নিয়ে অথৈ সাগরে হীরামনি। নতুন করে শুরু
তার জীবন যুদ্ধ। দুই মেয়ে ও নিজে কাজ করে সংসারটা টেনে নিতে শুরু
করলেন।তারা বড় হলো।তাদেরকে বিয়ে দিলেন। হীরামনি কখনও ভিক্ষের ঝুলি আবার
কখনও অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবন চালিয়ে নিয়েছেন । সেখানে আমাদের দেশে আজ
কোন অবস্থানে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর আর তাদের সন্তানেরা, বিদেশে তাদের
হয় পড়াশোনার ব্যবস্থা, কোটি কোটি টাকার বিত্তবৈভবে বড় হয় তাদের নরম শরীর !
শেষ দিনগুলিতে ? শোনা যায়, হিরামনি উদ্বিগ্ন ছিলেন চা শ্রমিকদের ধানের জমি
নিয়ে। দেড়শো বছর আগে পূর্বপুরুষদের জঙ্গল কেটে এই জমিতে আবাদ করেছিলেন
তারা। কোম্পানীকে খাজনা দিয়ে ঐ জমিতে ফসল ফলান সেই শ্রমিকদের
উত্তরপুরুষেরা।সম্প্রতি সেই চাষের জমিটিুকু অকৃষিজমি দেখিয়ে সেখানে স্পেশাল
ইকোনমিক জোন ঘোষণা করা হয়েছে।হিরামনি কি ভাবতেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সর
কার সুবিচার করবে !
Source: http://spordha.com/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%9A%E0%A6%BE-%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%A4/
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment