রাজধানীর ইএমকে সেন্টারের এই প্রদর্শনীতে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল কামরুজ্জামান স্বাধীন ও রবেন মুর্মুর যৌথ একটি স্থাপনাশিল্প। এখানে দেখা গেল শত শত মাটির ইঁদুর ছেয়ে ফেলেছে ঘরবাড়ি, ফসলের ঢিবি। শিল্পীর ভাষায়, ‘যে ইঁদুর একসময় সাঁওতাল গোষ্ঠীরা শিকারের জন্য খুঁজে বেড়াত, আজ সেই ইঁদুর তাদের মাটির ঘরে। যথেচ্ছা বনবাদাড় উজাড় করার ফলে হারিয়ে গেছে প্যাঁচা, ইগল, চিল। এই প্রাণীরাই তো নিয়ন্ত্রণ করত ইঁদুরদের। এই সর্ববিধ্বংসী লোভ একদিন মানুষের নিজের ঘরবাড়িই দখল করে নেবে।’
শিল্পীর কথা শুনে আমরাও ভাবি, আসলেই তো, এভাবেই তো হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু—ঐতিহ্য, জীববৈচিত্র্য, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি।
যে প্রদর্শনী দেখে আমাদের মনে এসব প্রশ্ন ও ভাবনা বুদ্বুদ তুলেছিল, সেটি কেবল প্রদর্শনী নয়, পরিবেশকে উপজীব্য করে কর্মশালাভিত্তিক একটি প্রদর্শনী। নাম ‘ইন-সাইট’। আয়োজক গিদরী বাউলি ফাউন্ডেশন অব আর্টস। কর্মশালাভিত্তিক এই প্রদর্শনীর একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে—সাঁওতালদের বিভিন্ন রকম শৈল্পিক ভাষা ব্যবহার করে স্থানীয় জনগণের মধ্যে পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষার সচেতনতা তৈরি করা। এ জন্য গেল ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা থেকে পাঁচ তরুণ শিল্পী গিয়েছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের মোনালীপাড়ায়। ৭০টি সাঁওতাল পরিবারের বাস এখানে। এই শিল্পীরা সাঁওতাল শিল্পীদের সঙ্গে মিলে আট দিনের কর্মশালার মাধ্যমে তৈরি করেন বিচিত্র শিল্পকর্ম—আলোকচিত্র, স্থাপনাশিল্প ও পারফরম্যান্স আর্ট; যা স্থানীয়, বিশেষ করে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে তুলে ধরেছে।
আসুন দেখা যাক কেমন ছিল কর্মশালাভিত্তিক প্রদর্শনীর কাজগুলো।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা নিয়ে আগ্রহী তাহমিনা হাফিজ। তাঁর কাজে প্রকাশিত সেই আবহ। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠানে সাঁওতালরা নানা রকম মাটি দিয়ে তৈরি রঙেই রাঙিয়ে তোলে নিজেদের ঘরের দেয়াল। তাহমিনা এই মাধ্যমকে ব্যবহার করেই মালতী সরেন, কমল টুডু ও অন্য অনেককে সঙ্গে নিয়ে দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান।
আবার সুনীল টুডুসহ অন্য গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে মাটির হাঁড়ি দিয়ে সাঁওতাল বীর সিধু-কানুর স্মরণে একটি অস্থায়ী স্তম্ভ তৈরি করেছেন নিলয় আই হোসেন। তাঁর ভাষ্য, ‘ওদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, ওরা ওদের গৌরবের ইতিহাসকে দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে। তাই এমন একটি শিল্পকর্ম তৈরি করেছি।’
সাঁওতাল নাচের ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন ইয়াসমিন জাহান। কর্মশালার পুরোটা সময় সহশিল্পী রাসমণি টুডু, মালতী হাসদা, ছবি হাসদা ও গীতা কিস্কুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সাঁওতালি নাচের মুদ্রা, ভঙ্গি, গতি ও ছন্দ। কর্মশালার শেষ দিনে ছিল তাঁর নিরীক্ষাধর্মী পারফরম্যান্স আর্ট।
এই প্রদর্শনীতে ছিল না, কিন্তু কর্মশালায় ছিল—এমন একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনাশিল্প হলো হাসানুর রহমান ও সুকল সরেনের ‘হরোডালগান্ডো’। সাঁওতালরা ধানমাড়াইয়ের কাঠকে চেনে ‘হরোডালগান্ডো’ হিসেবে। এই স্থাপনাশিল্পের ছিল ৫০ বছরের পুরোনো দুটি কাঠের খণ্ড। তার চারপাশে ধান ছড়ানো। বছরের পর বছর ধানমাড়াইয়ের ফলে কাঠ দুটির শরীরও হয়ে উঠেছে চকচকে মসৃণ। কিন্তু এই প্রবল যান্ত্রিক যুগে আর কত দিন এই কাঠ দুটি টিকে থাকতে পারবে?
আলোচ্য কর্মশালা ও প্রদর্শনীটি নিঃসন্দেহে অন্য রকম ভাবনা ও তাৎপর্য নিয়ে এসেছিল আমাদের কাছে। সমকালীন শিল্পীদের জন্য এ ধরনের অভিজ্ঞতার মূল্য যেমন অপরিসীম, একইভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করতে এ ধরনের উদ্যোগ রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ইএমকে সেন্টারে ১৯ এপ্রিল শুরু হওয়া প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ২১ এপ্রিল।
Source: http://www.prothom-alo.com/art-and-literature/article/843925/%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%93%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF
0 comments:
Post a Comment