Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

বগুড়ার সাঁওতাল পল্লীতে

প্রতীক ওমর, বগুড়া
ছোট ছোট খুপরি ঘর। সারিবদ্ধভাবে তোলা। খড়কুটো দিয়ে তৈরি চাল এবং বেড়া। মাটির মেঝে। সমতল থেকে দেড় ফুট উঁচু। ছিমছাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং বেশ পরিপাটি ঘরগুলো দেখতে। নিরিবিলি। চারপাশ কোলাহলমুক্ত। মূল সড়ক থেকে বেশ দূরে অবস্থান। দুই হাজার ছোট-বড় ঘরে মানুষের সংখ্যা তিন হাজার হবে। আদিবাসী সাঁওতাল পল্লী। এখানে বাস করে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। বগুড়া থেকে ওই জায়গার দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার।

উত্তরের উপজেলা গোবিন্দগঞ্জ সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার যেতে হয় দিনাজপুর রোড হয়ে পশ্চিম দিকে। ওই উপজেলার সাবমারা ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতালদের পল্লীটি অবস্থিত। রংপুর চিনিকলের একটি আখা ফার্মের দক্ষিণ-পশ্চিম ধারে ওই সাঁওতালদের বাস। মূল রাস্তা থেকে বেশ ভিতরে যেতে হয়। ইট বিছানো রাস্তায় আমাদের পাঁচটি মোটরসাইকেল তাদের গ্রামের সীমানায় পৌঁছতেই একটি ১৪-১৫ বছরের শিশু ঘর থেকে ঢোল বের করে পাগলের মতো বাজাতে থাকল। ঢোল বাজানোর কারণ তখনো আমরা কেউ বুঝে উঠতে পারিনি। এভাবে মিনিট পাঁচেক বাজাতেই সব দিক থেকেই সাঁওতালরা তীর ধনুক, ফালা, ছুরি, লাঠি হাতে এক হাজারের মতো সাঁওতাল নারী-পুরুষ এবং শিশু আমাদের ঘিরে ফেলল।

আমাদের শত্রু মনে করার আগেই সঙ্গে যাওয়া স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল হান্নান এবং জাহিদুল ইসলাম জাহিদ সাঁওতালদের একজন বয়স্ক লোকের কাছে গিয়ে বোঝালেন আমরা আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। আমরা সাংবাদিক। আপনাদের খোঁজখবর নিতে এসেছি। বয়স্ক ওই সাঁওতালকে বোঝানো সম্ভব হয়েছে। তিনি তখন ওই শিশুকে ঢোল বাজানো থামাতে বললেন। আমরা তাদের শত্রু নয় এটা নিশ্চিত হওয়ার পর সবাই তখন আমাদের মেহমান হিসেবে তাদের পল্লী, ঘরবাড়ি ঘুরে দেখালেন। ওই দিন আদিবাসী পল্লীতে আমাদের দিনের একটা বড় অংশ সেখানকার সাঁওতালদের সঙ্গে কেটেছে।
ওই পল্লীর বাসিন্দাদের তথ্যমতে, সেখানে প্রায় তিন হাজার সাঁওতালের বাস। এক সময় এখানকার সাঁওতালদের প্রধান পেশা ছিল বন্যপ্রাণী শিকার করা। তাদের জীবন ও জীবিকা চলত জঙ্গল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী বধ করেই। কালের পরিক্রমায় প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সাঁওতালদের পেশাও পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন চাষাবাদ করে। নিজেদের জমিজমা নেই। অনেকটা ভূমিহীন তারা। অন্যের জমিতে কাজ করেই এখন তাদের সংসার চলে। মাথা গোঁজার জন্য ছোট ছোট খুপরি ঘর তৈরি করেছে তারা। ঘরগুলোর বেড়া এবং চাল খড়কুটো দিয়েই তৈরি। সেই ঘরে একজনের বেশি থাকা যায় না। কিছু ঘর তুলনামূলক একটু বড়। সে ঘরে অবশ্য একাধিক মানুষ থাকে। ঘরের ভেতর বাঁশের একটি করে মাচা আছে। সেই মাচাতেই রাতে তারা ঘুমায়।
সাঁওতালরা দলগতভাবেই বসবাস করে। তাদের গোত্রের বয়স্ক ব্যক্তিই দলপ্রধানের ভূমিকা পালন করেন। শত্রুর মোকাবেলা থেকে শুরু করে যেকোনো কাজের নেতৃত্ব দেন তাদের দলপ্রধান। তাদের কেউ বিপদে পড়লে অথবা শত্রুর আক্রমণ হলে সবাই মিলে সেই শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এজন্য সবার ঘরে একটি করে বিশেষ ধরনের ঢোল আছে। যখন কেউ বিপদে পড়ে তখন সেই ঢোল বিশেষ কায়দায় বাজাতে থাকে। ঢোলের শব্দ পেয়েই সেদিকে দ্রুত এগিয়ে আসে প্রতিবেশী সাঁওতালরা। এরা শত্রুর মোবাবেলায় তীর-ধনুকের ব্যবহার করে থাকে। বাঁশ এবং বেতের তৈরি তাদের এই যন্ত্রটি কম বেশি সবাই তৈরি করতে পারে। অতিরিক্ত তীর বহনের জন্য এরা পিঠে বাঁশের তৈরি একটি বাহনও রাখে।
সাঁওতালদের মধ্যে বেশির ভাগ খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। এছাড়াও সনাতন হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্মের অনুসারীও আছে। তবে তাদের সংখ্যা কম। এরা নিজ গোত্রের বাইরে অন্য গোত্রের সঙ্গে পরস্পরের বিয়ে দিয়ে থাকে। সাবমারা এলাকার সাঁওতালদের আত্মীয়স্বজন এবং গোত্রের একটা অংশ পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুরে থাকে। তাদের মধ্যে যাতায়াত এবং ভালো যোগাযোগ আছে। বিয়ের পর্বগুলোর বেশির ভাগ ওই দুই জায়গার মধ্যেই পাত্র-পাত্রীর আদান-প্রদান হয়ে থাকে।
সাঁওতালরা পরস্পরের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বললেও বাংলা ভালো বলতে এবং বুঝতে পারে। তাদের নানা ধরনের দুঃখ কষ্ট শেয়ার করলেন আমাদের সঙ্গে। কথা হয় ৭০ বছরের হোপনা মরমুর সঙ্গে। তিনি বলেন, এক সময় তাদের জমিজমা, নিজেদের বাড়ি ছিল। ১৯৫৫-৫৬ সালে এখানকার সাঁওতাল, খ্রিস্টান ও সনাতন সম্প্রদায়সহ কিছুসংখ্যক মুসলিম পরিবারের কাছ থেকে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন পাকিস্তান শিল্প মন্ত্রণালয় রংপুর চিনিকলের ইক্ষু খামারের জন্য। বর্তমানে সেই জমিতে আখের চাষ না করে স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় জমিগুলো লিজের মাধ্যমে দখলে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। ইতিমধ্যে কিছু জমি তারা দখলে নিয়ে পুকুর খনন করেছে। ভোবেন মার্ডী জানান, রংপুর চিনিকল (রচিক) কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ নীতিমালা অমান্য করেছেন। তারা জমিতে আখ উৎপাদন না করে ধান, পাট ও কলার আবাদ করছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে লিজ দেওয়া হয় কয়েকশ একর জমি। তারা দাবি করেন তাদের বাপ-দাদার এই বিশাল সম্পত্তির মালিক এখন তারা। সরকার যেন তাদের জমি ফিরিয়ে দেয়।


এদিকে সাঁওতালদের ওই পল্লীতে আধুনিকের কোনো ছোঁয়াই নেই। নেই ডিজিটাল বাংলাদেশের কোনো চিহ্ন। বিদ্যুতের আলো, টেলিভিশন নেই। নেই ডিশ লাইনও। আধুনিক বাংলাদেশ থেকে তারা অনেক দূরে অবস্থান করছে। কিছু কিছু সাঁওতাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও এর সংখ্যা অনেক কম। রাতে তাদের প্রত্যেকের ঘরে এবং বাইরে মশাল জ্বলে। দূর থেকে এসব মশাল দেখে ওই জায়গাকে দ্বীপ মনে হয়। এদের পাঁচ শতাধিক পরিবারে তিন হাজার মানুষের মধ্যে শিশুর সংখ্য পাঁচ শতাধিক। এই শিশুদের লেখাপড়ার জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। কিছু শিশু পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্কুলগুলোতে গেলেও দূরত্ব এবং নিজ ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় টিকতে পারে না। অন্যদিকে এই শিশুদের অধিকাংশই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাদের খাদ্যের মান অত্যন্ত নি¤œ। ভাত আর আলু এখন তাদের প্রধান খাদ্য। নেই চিকিৎসা সেবার ভালো কোনো ব্যবস্থাও।

মিতুম ফুলমাডি, রুপাই টুডু, ফাতু টুডু, মেনতি, বাদল ছরেন, মামলী, মানেস কিসবু, কমলেস ও হেমরন বলেন, আমরাও অন্য মানুষের মতো ভালো থাকতে চাই। আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চাই। তারা অভিযোগ করেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করার বিপরীতে কোণঠাসা করে রেখেছে। সম্প্রতি ওই নেতারা রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পুলিশ দিয়ে সাঁওতালদের বেশ কিছু ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়ে দিয়েছে এবং তাদের জায়গাগুলো দখল করেছে। সেই সঙ্গে তাদের নামেই মামলাও দিয়েছে। এখন সাঁওতালরা পুলিশ, রংপুর চিনিকলের লোকজন এবং স্থানীয় এমপি বাহিনীর ভয়ে সীমানার বাইরে যেতে পারছে না। এমনকি হাট-বাজার করাও বন্ধ রয়েছে।
Source:  http://www.dhakatimes24.com/2016/08/06/122765
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment