সাঁওতালরা পূর্বভারত ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির
একটি। তারা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠির অন্তর্গত একটি ভাষা সাঁওতালী
ভাষায় কথা বলে ।
সাঁওতালরা দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে বাস করে। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট ,
ফুলবাড়ি, চিরিরবন্দর , কাহারোল এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিক
সংখ্যায় বাস করে। রাজশাহী এবং বগুড়া অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সাঁওতাল আছে।
প্রাচনিকাল থেকেই সাঁওতালরা এদেশে বসবাস করে আসছে। এরা মোট ১২ টি গোত্রে
বিভক্ত সাঁওতালী ভাষায় এ গোত্র গুলো ‘পারিস‘ নামে অভিহিত যেমন – হাঁসদা,
সরেন,টুডু, কিসকু, র্মুমু, মার্ড়ী, বাস্কে, ইত্যাদি ।
সাঁওতালদের মধ্যে অধিকাংশই খ্রিষ্টান ধর্মের হলেও কিছু কিছু হিন্দু ধর্ম
বিশ্বাসী সাঁওতাল পরিবার তাদের আদি সংস্কৃতি এবং ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে।
এসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবন ও ধর্ম চর্চায় উজ্জ্বল রঙ্গীন ফুলের
কদর অনেক বেশি। বিশেষ করে লাল জবা ফুল তাদের পুজা পার্বনে এবং উৎসব পরবে
বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত হয়। এদের মেয়েরা রঙ্গীন শাড়ি পড়ে চুলে রঙ্গীন ফুল
গুঁজে নাচে গানে উৎসব পালন করে থাকে। স্ত্রী পুরুষ উভয়েই সামাজিক রীতি
হিসেবে শরীরে উল্কি আঁকে। এদের বিয়ে হয় ধুম ধামে অনেকটা সাঁওতালদের বিয়ের
অনুকরনে। বিয়েতে নাচ গান এবং ভাত পচানো ওদের বাড়ীতেই তৈরি করা চোলাই মদ
থাকতেই হবে। এই মদ আর পাঁঠা বা শুকুরের মাংসের সাথে মোটা চালের ভাতের ভোজ
দিয়েই চলে বিয়ের বাড়ীর আহার পর্ব। আদিবাসীদের মধ্যে স্ত্রী পুরুষের এক
সঙ্গে দুই স্ত্রী বা স্বামী রাখার বিধান এদের নেই। এখনও এদের সমাজে প্রাচীন
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এদের মধ্যে বিধবা বিয়ে এবং ঘরভাঙ্গা বিয়ে
প্রচলিত আছে, তবে শিশু বিয়ের প্রচলন কম।আগে গারোদের মত দেকাচোঙ ঘর এবং
সাঁওতালদের আখ্রা ঘরের মতো বিবাহযোগ্য তরুণ তরুনীরা বিয়ের আগে পরস্পরের
সাথে মেলা মেশার সুযোগ পেতো। বড় গোলা ঘর, যাকে বলা হয় ধুমকুরিয়া। এই
গোলোঘরে নিদৃষ্ট পরবের দিনে একসঙ্গে একাধিক বিবাহযোগ্য নারী পুরুষ একত্রে
বসে তাদের পছন্দ মতো পাত্র পাত্রী নির্বাচন করতো। পরে পরিবারের লোকজনের
সম্মতিতে বিয়ে হতো। এখন আর সে প্রথার প্রচলন বা সুযোগ নেই।তবে পুরুষদের
চেয়ে মেয়েরা বেশী পরিশ্রম করে এবং কৃষি কাজেও তারা অত্যন্ত দক্ষ।
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে সাঁওতালদের মোট সংখ্যা ২০২৭৪৪,
২০১২ সাল নাগাদ ওদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ানোর কথা কমপক্ষে ২৭১৪৮৫; কিন্তু
প্রকৃতপক্ষে ওদের সংখ্যা তিন লাখের বেশি হবে। কিন্তু ১৯৪১ সালের ব্রিটিশ
ভারতের আদমশুমারি রিপোর্ট দেখলে পাওয়া যায় তখন সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল
৮২৯০২৫ জন যার ভেতরে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে সাঁওতাল ছিলো ২৮২৬৮২ জন।
অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সাঁওতাল এর সংখ্যা যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়ে নি,
উল্টো কমেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নানা অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়ন,
হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি কারণে এরা দলে দলে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয় । এদের অনেকেই
চলে গেছে পাশের দেশ ভারতে যেখাতে সাঁওতালদের বর্তমান সংখ্যা ৬ লাখের মতন,
আর নেপালে ৫০ হাজারেরও বেশি।
অস্ট্রিক গোষ্ঠির সাথে সাঁওতালদের চেহারায় ব্যাপক মিল আছে। এদের দৈহিক
বৈশিষ্ট্য হলঃ খজর্বাকৃতি, মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি, নাক চওড়া ও
চ্যাপ্টা, গায়ের রঙ কালো এবং ঢেউ খেলানো । ভাষাগত পরিচয়ে এরা
অস্ট্রো-এশিয়াটিক। নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা এরা ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের
অন্যত্ম। এক সময় এরা বাস করতো উত্তর ভারত থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের
ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। আনুমানিক ৩০ হাজার বছর পূর্বে এরা ভারত থেকে
অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল। আর সাঁওতালরা যে আর্যদের আগে থেকেই ভারতে আছে সে
ব্যাপারে কোনই দ্বিমত নেই। এদের আদি নিবাস হয়েছিল হাজারিবাগ, মালভূম
(চায়-চাম্পা), এবং বিহারের আশ-পাশের বিভিন্ন অঞ্চল। মোঘল আমলে এরা
হাজারীবাগ, মালভূম হতে বিতাড়িত হয়ে ওড়িষ্যার সাঁওতাল পরগণায় চলে আসে।
সাঁওতালরা আজও নিজেদেরকে বলে ‘হোড়’ কিংবা ‘হেড়’ যার অর্থ মানুষ আর ওদের
কারমণকারী মানুষদেরকে বলে ‘দিকু’ যার অর্থ আক্রমণকারী কিংবা ডাকাত। ওরা
প্রকৃত অর্থেই নিপীড়িত এক গোষ্ঠী। অশিক্ষিত সাঁওতালদের সরলতার সুযোগ নিয়েছে
শিক্ষিত ধনীক গোষ্ঠী। জমিদার, মহাজন, প্রশাসক ও স্থানীয় প্রভাবশালী
হিন্দু-মুসলমান ওদেরকে করেছে শোষণ আর ইংরেজরা করেছে অত্যাচার।
বাংলাদেশে সাঁওতালদের আগমন ঘটেছে নানা কারণে। এর মধ্যে জমিদার-মহাজনেরা
যেমন তাদের কাজের প্রয়োজনে সাঁওতালদের উত্তরবঙ্গে এনেছেন, তেমনি এরা
নিজেরাই জীবিকার সন্ধানে, খাদ্য ও বাসস্থল সংকটে, এমনি কি ১৮৫৫ সালে
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণে ইংরেজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে এ অঞ্চলে বাসস্থান
গড়েছে।
তথ্যসুত্র ও ছবিঃ সংগ্রহ
https://wonderfulbangladesh.net/tag/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%93%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2/
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment