[[ জানা গেছে, যে জমি নিয়ে সংঘর্ষের শুরু,
সেখানে আখের খামার তৈরির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট
করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ১৯৬২ সালের ৭
জুলাই। চুক্তির ৪ নং শর্তে বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে,
তা ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ সম্পত্তি ব্যবহার করা যাবে না।
চুক্তির ৬ নং শর্তে বলা হয়, জমি অন্য
উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইলে সরকারের লিখিত আদেশ লাগবে। এছাড়া ৫ নং শর্তে
আরো বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে
ব্যবহার করতে হলে আগে প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যাতে
সরকার জমি মুক্ত করে ফেরত দিতে পারে। ]]
সারি বাঁধা প্রায় আড়াই হাজার ঘরের একটিও
অবশিষ্ট নেই। পড়ে আছে শুধু ছাই। পাহারারত ডজনখানেক পুলিশ সদস্য ছাড়া
জায়গাটি এখন প্রায় জনমানবশূন্যই বলতে হবে। এ রকমই একটি সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া
ঘরের ধ্বংসাবশেষের নিচে গর্ত হাতড়াছিলেন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সত্তরোর্ধ্ব
বৃদ্ধা ফুল মার্ডি। কাছে গিয়ে দেখা গেল, লুকানো শামুক তুলছেন তিনি।
ফুল মার্ডি জানালেন, ঘর পোড়ানোর সময় কিছু
নিতে পারেননি, যা কিছু ছিল সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শামুকগুলো লুকানো ছিল আগে
থেকেই। কিন্তু কাছে আসার সাহস পাননি। এ প্রতিবেদককে দেখে কিছুটা সাহস পেয়ে
ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে শামুকগুলো তুলতে এসেছেন তিনি।
জয়পুর ও মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দারা না
খেয়ে আছে দুদিন ধরে। পুলিশ ও স্থানীয় চিনিকলের শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর
থেকে বের হলেই মারধরের শিকার হচ্ছে তারা। ফলে কোনো কাজ করে অর্থ উপার্জনের
পথও খোলা নেই তাদের। এ কারণে দুদিন ধরে না খেয়ে আছে সাঁওতাল অধ্যুষিত
গ্রাম দুটির বাসিন্দারা।
পুড়ে যাওয়া ঘরের পাশে জঙ্গল থেকে
কাঁথা-বালিশ নিয়ে বের হচ্ছিলেন সাবিনা হেমব্রম (৩৫) ও রাজমণি হেমব্রম।
সাবিনা বলেন, ঘরে যখন আগুন দেয়া হয়, এছাড়া আর কিছুই নিতে পারিনি আমরা। এ
দুদিনে ঘরেও আসতে দেয়া হয়নি। আজ মানুষ দেখে এলাম। দুটি গরু, তিনটি বকরিসহ
সবই লুট করে নিয়ে গেছে। পুলিশ আমাদের হাঁস-মুরগি নিয়ে বেচে দিচ্ছে, নিজেরা
রান্না করে খাচ্ছে। স্বামী ও দুই ছেলেমেয়ে সবাই না খেয়ে আছি।
রাজমণি হেমব্রমের পরিবারেরও এখন কাঁথা-কম্বল ছাড়া আর কোনো সম্বল নেই। সবই লুট হয়ে গেছে।
রাজমণি হেমব্রমের পরিবারেরও এখন কাঁথা-কম্বল ছাড়া আর কোনো সম্বল নেই। সবই লুট হয়ে গেছে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর সুগার
মিলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে রোববার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সাঁওতাল ও
বাঙালিদের প্রায় আড়াই হাজার ঘর। ঘটনাটি ঘটে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ
অভিযানের সময়। অভিযানের পর পরই শুরু হয় লুটপাট। ঘর, কাঁথা-বালিশসহ আগুনে
পুড়ে মারা গেছে প্রচুর গবাদি পশু। যা ছিল অবশিষ্ট, তাও লুটে নিয়েছে
দুর্বৃত্তরা। এ লুুটপাট চলে রোববার সারা রাত ধরে। ওই সময় যা অবশিষ্ট ছিল,
পরদিন সকালে আবার হামলা করে লুটে নেয়া হয় সেটুকুও।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা শেফালী সরেন (৬৫)
বলেন, আমরা এখানে কীভাবে থাকব? এক কাপড়ে আছি, কিছু আনতে পারিনি। দুদিন ধরে
এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। স্বামী আছে বয়স্ক, কিছু করে না। ভ্যান ছিল, ভাড়া
দিয়ে খেতাম। ওরা ভ্যানটিও নিয়ে গেছে। এত কিছুর পরও বৃদ্ধার কণ্ঠে দৃঢ়
প্রত্যয়— সব গেছে যাক, তবু আমাদের বাপ-দাদার ভিটা আমরা ফেরত নেবই।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চিনিকলের শ্রমিকসহ আশপাশের গ্রামের লোকজনও এ লুটপাটে
যোগ দেয়।
তারা জানিয়েছেন, ৬ নভেম্বর সকালে পুলিশ
প্রহরায় সাহেবগঞ্জ আখ খামারের বীজ-আখ কাটতে যান রংপুর চিনিকলের শ্রমিকরা। এ
সময় বাধা দিতে গেলে মিলের শ্রমিকদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে সাঁওতাল ও
বাঙালিদের। প্রায় ২ ঘণ্টার এ সংঘর্ষে আহত হন নারী-পুুরুষসহ অর্ধশতাধিক। এ
সময় বাধা দিয়ে কাজ না হলে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে সাঁওতালরাও তীর ছোড়ে।
তাদের তীরের আঘাতে আহত হন পুলিশের পাঁচ সদস্য। সংঘর্ষে পিছু হটে যায়
পুলিশ। এ সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন কয়েকজন সাঁওতাল।
পরে বিকালে সাহেবগঞ্জ আখ খামারে যৌথ অভিযানে নামে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। এ সময় পুলিশ ৬০-৭০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে বলে গ্রামবাসী জানান। সাঁওতাল ও বাঙালিদের আড়াই হাজার ঘর তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। অভিযানের সময়ই সব ঘর আগুনে পুড়ে যায় বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তাদের অভিযোগ, পেট্রল ঢেলে এসব বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে ঘরের টিন ও গবাদিপশুসহ সাঁওতালদের কাঁথা-কম্বলও লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। রাবার বুলেটে বিদ্ধ পবন হেমব্রম (৩০) জানালেন, সকালে পুলিশ তিনবার গুলি করার পরই সাঁওতালরা তীর মেরেছে।
সকালের সংঘর্ষে আরেক গুলিবিদ্ধ শ্যামল
হেমব্রম সংঘর্ষের পর হাসপাতালে নেয়ার পথে রোববারই মারা যান। এছাড়া
পরবর্তীতে শস্যক্ষেতে আরো তিনটি মরদেহ দেখা গেছে বলে দাবি করেছেন
সাঁওতালরা। পরে পিকআপে করে পুলিশ এসব মরদেহ নিয়ে গেছে বলে ধারণা করছেন
তারা।
সোমবার রাতে বাগদা ফার্ম এলাকায় ধানক্ষেতে
একটি মরদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা খবর দিলে তা উদ্ধার করে গাইবান্ধা সদর
হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। নিহত আরেকজনের নাম মাঝি মুরমু
(৪৫) বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মাঝি মুরমুর পরিবারের সদস্যরা গতকাল বিকাল
পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি। বেলা ৩টার দিকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে
আলোচনায় ঘটনার পর থেকে তার মামাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন মাঝি
মুরমুর বোনের মেয়ে সুজলা সরেন।
স্থানীয় বারণ মুরমুর ধারণা, মরদেহ তিনটির
একটি ছিল মাঝি মুরমুর। নিহত বাকি দুজন সুনিল সরেন ও স্বপন সরেন। ঘটনার পর
থেকে নিখোঁজ রয়েছেন তারা দুজনই। গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল মর্গে আরেকটি মরদেহ
রয়েছে বলে জানা গেছে গতকাল সকালে।
এদিকে সাঁওতালদের অভিযোগ অস্বীকার করছে
পুলিশ। গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সরকার
বলেন, সাঁওতালদের বাড়িঘরে কে বা কারা আগুন দিয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের জানা
নেই। আমরা গিয়েছিলাম মামলার আসামি ধরতে। দুই সাঁওতালের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি
বলেন, ময়নাতদন্তের পরই প্রাণহানির কারণ জানা যাবে।
জানা গেছে, যে জমি নিয়ে সংঘর্ষের শুরু,
সেখানে আখের খামার তৈরির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট
করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ১৯৬২ সালের ৭
জুলাই। চুক্তির ৪ নং শর্তে বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে,
তা ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ সম্পত্তি ব্যবহার করা যাবে না।
চুক্তির ৬ নং শর্তে বলা হয়, জমি অন্য
উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইলে সরকারের লিখিত আদেশ লাগবে। এছাড়া ৫ নং শর্তে
আরো বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে
ব্যবহার করতে হলে আগে প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যাতে
সরকার জমি মুক্ত করে ফেরত দিতে পারে।
২০০৪ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে
লোকসানে থাকা রংপুর চিনিকলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে
২০০৬ সালে মিলটি আবার চালু হলেও সেখানে আখ চাষের পাশাপাশি অন্য ফসল আবাদের
জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দেয় চিনিকল কর্তৃপক্ষ।
এতে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তোলেন স্থানীয়
বাঙালি ও সাঁওতালরা। পরে জমির মালিকানা দাবি করে আন্দোলনে নামেন তারা।
স্থানীয় জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনেও চুক্তি ভঙ্গের বিষয়টি উঠে আসে। এরই
ধারাবাহিকতায় স্থানীয় বাঙালি ও সাঁওতালরা গত জুনে ওই জমিতে ঘর তৈরি করে
বসবাস শুরু করে। ওই সময় থেকে গড়ে ওঠা প্রায় আড়াই হাজার ঘরের সবই পুড়িয়ে
দেয়া হয় গত রোববার।
0 comments:
Post a Comment