Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

মতামত : সৎকারের অপেক্ষায় ভূমিপুত্রের লাশ

শাহানা হুদা | ১০ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:০১
[[ গরু-ছাগল, বাড়ির জিনিসপত্র লুটপাটের পর আহাজারি করছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মাদারপুর গ্রামের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন। আজ দুপুরে ছবিটি তোলা। ছবি: প্রথম আলো ]] 
ছবিটি দেখার পর থেকে মনটা কষ্টে ছেয়ে আছে। একজন দারিদ্র্যপীড়িত ভূমিপুত্র মরে পড়ে আছেন খোলা প্রান্তরে। মরদেহটি ময়নাতদন্তের পর ঢেকে রাখারও প্রয়োজন মনে করেনি পুলিশ কর্তৃপক্ষ। মাঠে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। বয়স্ক কালো মানুষটির চোখ দুটি বন্ধ হলেও মনে হচ্ছে কোনো নিপীড়ন ও অত্যাচারের কথা বলতে বলতে উনি চোখ বুজেছেন। গাইবান্ধা থেকে এক মানবাধিকারকর্মী ছবিটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন।

ফোনে কথা হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গাইবান্ধা শাখার সাবেক সভাপতি রাফায়েলের সঙ্গে। উনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মরদেহটি এভাবে পড়ে আছে। একটা স্থানীয় সাঁওতাল পুরুষ পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সৎকার করবেন। আমরা তো এ কাজটি করতে পারছি না। নিজেদের এত অসহায় আর অপরাধী মনে হচ্ছে। কী যে করি, বুঝতে পারছি না!’
দ্বিজেন টুডুর চোখে গুলি লেগেছে। রংপুর মেডিকেল তাঁকে রিলিজ করে দিয়েছে এবং চোখের চিকিৎসার জন্য রংপুর ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে প্রথমে আদালতে নিয়ে যেতে চায়, তারপর ম্যাজিস্ট্রেট যা আদেশ দেবেন, সে অনুযায়ী দ্বিজেনের ব্যবস্থা করবে। বাহ! চোখ নষ্ট হয় হোক, আগে বিচার হবে। ‘সাঁওতালেরা মানুষ না, তাদের পোকামাকড়ের মতো মেরে ফেলা যায়। চোখ থাকলেই কী, আর গেলেই-বা কী?’ কথাটি বললেন দ্বিজেনের সঙ্গে আসা জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
বলছি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জের সাঁওতাল-অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামের একজন নিহত ও দুই আহত সাঁওতাল যোদ্ধার কথা। সাঁওতালদের আরেকটি নাম ভূমিপুত্র। ইংরেজিতে যাদের বলে ‘সন্স অব দ্য সয়েল’। এই সংগ্রামী, সাহসী ও সহজ-সরল মানুষগুলোকে বরাবর যুদ্ধ করতে হয়েছে জমিদার, ভূমিগ্রাসকারী মহল, সুদখোর ও পুলিশের সঙ্গে। সেই ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলন ছিল তাদেরই আন্দোলন। সাঁওতালদের ইতিহাস হচ্ছে আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস। নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সব সময়ই তাদের পথে নামতে বাধ্য করা হয়েছে।

সাঁওতাল গ্রামটিতে চালানো হয়েছে লুটপাট, মারধর করা হয়েছে সাঁওতাল নারী, পুরুষ, শিশু সবাইকে। আগুন দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়িঘরে, জিনিসপত্রে। সাঁওতাল পুরুষেরা তাঁদের এলাকায় ফিরতে পারছেন না। তাঁরা নিরুপায় ও দুর্বল বলে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল তাদেরÿমতামত খাটাচ্ছে। সাঁওতাল নেতা ফিলিমন বাস্কে ফোনে বললেন, ‘আমাদের অসহায় পেয়ে ওরা এই অত্যাচার চালায় যাচ্ছে। মাইনসি মারা গেইছে, তাও আমরা যাবার পারতেছি না। এমনকি হাসপাতালতও যাবার পারতেছি না। বাচ্চাকাচ্চার খাওয়াদাওয়া, স্কুল সব বন্ধ।’
বাংলাদেশে যত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে, তাদের মধ্যে সাঁওতালদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও অবস্থানগত ও অধিকারের দিক দিয়ে এদের অবস্থান নিচে। সামাজিকভাবেও এই মানুষগুলোকে অচ্ছুত করে রাখা হয়েছে কোনো কোনো এলাকায়। পূর্ব বাংলা বা আজকের বাংলাদেশে এরা ঠিক কবে, কীভাবে এসেছে, তা খুব সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও ১৮৮১ সালের শুমারি অনুযায়ী পাবনা, যশোর, খুলনা ও চট্টগ্রামে সাঁওতালপল্লি ছিল। বর্তমানে দিনাজপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, পঞ্চগড়, নাটোর, ঠাকুরগাঁও, সিলেট, জয়পুরহাট ও মৌলভীবাজারে এদের বাস। সংখ্যায় এরা বেশি হলেও পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসাসহ সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে। এরা দরিদ্র এবং দরিদ্র বলেই বাধ্য হয় খুব স্বল্প মজুরিতে তাদের শ্রম বিক্রি করতে। প্রতিনিয়ত জমির মালিক ও কর্জদাতারা তাদের জমি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে ভূমির ওপর এদের অধিকারবোধ অনেক বেশি।
কেন সাঁওতালেরা চিনিকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে গেল, কেন আজ তারা ঘরছাড়া, কেন তাদের মারা যেতে হচ্ছে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে? এগুলো বুঝতে গেলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। সাঁওতালেরা বনবনানী ও ভূমি পরিষ্কার করে নিজেদের বসতি তৈরি করে। কৃষিকাজ শুরু করেছিল ব্রিটিশপূর্ব আমলে। ঔপনিবেশিক আমলে চেষ্টা হয়েছিল সাঁওতালদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়ার। সাঁওতালেরা তখনো তাদের অধিকার ছেড়ে দেয়নি। তারা ঔপনিবেশিক শোষণের বিরোধিতা করেছিল। কারণ, সাঁওতালেরা বিশ্বাস করত, যারা জমিটিতে প্রথম বসতি স্থাপন করেছে, তারাই ভূমির মালিক। মোগলরা তাদের এই বিশ্বাস মেনে নিয়েছিল বলে কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এসে জমিদাররা বহুবার এসব জমি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আর সাঁওতালেরাও বারবার তা প্রতিহত করেছিল। বাঙালি জমিদার, জোতদার, দোকানদার ও রেলওয়ের ঠিকাদারদের দ্বারা অব্যাহতভাবে সাঁওতালেরা প্রতারিত ও নিপীড়িত হয়েছে বলে জমিজমার ব্যাপারে তাদের বিশ্বাস একেবারে শূন্যের কোঠায়।

এমনকি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাঁওতালেরা যখন আর সবার সঙ্গে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, তখনো তাদের জমিজমা নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তারা ভারত থেকে ফিরে আসার আগেই তৎকালীন ভূমি কমিশন কৌশলে ভূমি মিউটেশনের কাজটি সেরে ফেলেছিল এবং সাঁওতালদের অনেক জমি গ্রাস করেছিল। এ রকম একটি চলমান অবিশ্বাসের সম্পর্কের কারণে বহুবার সাঁওতালদের সঙ্গে ভূমি নিয়ে প্রশাসন ও প্রভাবশালী মহলের বিরোধ বেধেছিল। সাহেবগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমি নিয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে মালিক-কর্তৃপক্ষের গোলযোগও এ রকম একটি। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল—কখনো জমিতে আখ ছাড়া অন্য কিছু আবাদ করলে ওই জমি মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু কিছুদিন ধরে ওই জমিতে আখ চাষ না হয়ে ধান ও তামাক চাষ হচ্ছে। কিন্তু কথা অনুযায়ী জমি ফিরিয়েও দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস এবং শুরু হয় বিরোধ। ফল হিসেবে ভিটেমাটি হারিয়ে পথে এসে দাঁড়াতে হচ্ছে এই ভূমিপুত্রদের।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
 Source: http://m.prothom-alo.com/opinion/article/1018093/%E0%A6%B8%E0%A7%8E%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B6
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment