Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

এদেশেতেই বাস, কেউ হয় আদিবাসী, কেউ হয় দাস - সামিয়া রহমান

প্রকাশ : বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
পোপ একবার মাইকেল এঞ্জেলোর কাছে তার সৃজনশীলতার পেছনের রহস্য জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন সব মাস্টার পিসের মাস্টার পিস ‘ডেভিড’-এর স্ট্যাচু তৈরির কাহিনী। মাইকেল এঞ্জেলো বলেছিলেন, এটা তো খুব সহজ। যা কিছু আছে তার চিরচেনা পুরাতন চিন্তায়, তার সব কিছুই তিনি সরিয়ে ফেলেছিলেন, মুছে ফেলেছিলেন। আর তখনই সম্ভব হয়েছে ‘ডেভিড’ তৈরি করা।  ঘটনাটি শুনেছিলাম, শুনেছিলাম কথাটা ঠিক নয় বরং বলা যায় পড়েছিলাম ‘রল্ফ ডবেলিই’-এর বিখ্যাত ‘দ্য আর্ট অফ থিঙ্কিং’ বইতে। ভুল না ঠিক জানি না কিন্তু ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো ফ্রান্স এবং ইতালি গিয়ে আমারও একটা নতুন উপলব্ধি হয়েছিল। তারা বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে না, বরং কাজের মধ্য দিয়েই তারা বাঁচে। এবং শিল্প হচ্ছে তাদের অস্তিত্ব, শিল্পের মধ্য দিয়েই তাদের জীবনযাপন। আমি বা আমরা যদি পারতাম জগতের যা কিছু মন্দ, যা কিছু অন্যায় সব ধুয়ে মুছে ফেলতে! যদি পারতাম জগতের বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে, সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে পাপকে সম্পূর্ণভাবে নির্বংশ করে নতুন করে সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে! বাঁচার জন্য কাজ নয়, বরং আনন্দের মধ্য দিয়ে কি এদেশে বেঁচে থাকা এতটাই অসম্ভব! কিন্তু বেঁচে থাকাই যেখানে প্রতিকূল, সে জগতে আনন্দ কোথায়!
‘রঙ্গীলা রঙ্গশালার আদম মোরা
করি সব আজগুবি কীর্তিকাণ্ড
দুই মিনিটের নাই ভরসা,
মাটির দুনিয়ারে করি খণ্ড বিখণ্ড।
ভক্তি দিলে মুক্তি মিলে কজনে তা বুঝে?
লোভ লালসার হিংসামিতে ভক্তি কে বা খুঁজে’
চারপাশে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। নীরব দর্শক অবশ্যই আর আমরা নই। সরবে সোচ্চার তুলি গণমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু বিধি বাম। আইন অন্ধ জানি, কিন্তু প্রশাসন কি অন্ধ! মনুষ্যত্ব কি অন্ধ!
নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর পাঁচবার হামলা হয়, আগুন জ্বালানো হয়। তুমুল আলোচনা চলে চায়ের আড্ডায়, গণমাধ্যমের বোকা বাক্সের গোল, লম্ব্বা বা চৌকনা টেবিলে। রাজনৈতিক দলরা তাদের প্রতিনিধি পাঠায়, অসহায় বা অসহায়ত্বের পাশে তারা আছে সেই প্রমাণে। কিন্তু ফিরে এসে সেই একই কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতির গর্তেই বিরাজ করেন তারা।
বুদ্ধিজীবীরা ইতিহাস বিশ্লেষণ করেন, নৃশংসতার শেকড়ের কারণ জানতে কঠিন কঠিন শব্দচয়নে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন কখনো ধর্মকে, কখনো প্রশাসনকে, কখনো বিভাজিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। কিন্তু কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো।
ঘটনা পাঁচবার না ঘটলে আমরা গণমাধ্যমে কি নিয়ে সংবাদ করব! এত ঘটনা! চারপাশে সংবাদের রমরমা বাণিজ্য। সংবাদের উৎসব না সংবাদের প্রতিযোগিতা! বাণিজ্যকে চাঙা করার সুযোগ দিয়েই বোধহয়, আমাদের চায়ের আড্ডায়, গণমাধ্যমের টকশো-এর বিষয়ের অভাববোধের তাগিদ যাতে না থাকে সেই মহান প্রচেষ্টায় বোধহয় আরও হামলা, আরও নিষ্ঠুরতা হয় আদিবাসীদের ওপর। সাঁওতালদের জমি থেকে উচ্ছেদে ফিল্মি স্টাইলে তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। হাসপাতাল থেকে আহত সাঁওতালকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় জেলহাজতে। অনেকটা সিনেমা, কিন্তু পুরোটাই আদতে জীবনের গল্প।
আইন বলে সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে সে ১৯৪৮ সালের আইন হোক বা ১৯৮২ সালের সংশোধিত আইন হোক। কিন্তু আইনেই আছে বৈধ বা অবৈধ হোক না কেন কাউকে বাড়িঘর উচ্ছেদে নোটিস দিতে হবে। নোটিস দূরে থাক যেভাবে গুলি চালানো হলো তাতে আইনের কী ব্যাখ্যা আছে তা আমাদের মতো আইন না জানা অজ্ঞদের খুব জানতে ইচ্ছা করে। আমাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্র যার দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা, জানমাল নিশ্চিত করা, সে রাষ্ট্রযন্ত্র কি ব্যাখ্যা দিতে পারে অসহায় সাঁওতালদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণে তাদের কতটা সুনাম বৃদ্ধি হয়েছে বা রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের আস্থা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে? স্থানীয় সংসদ সদস্যের ওপর সাঁওতালরা এতটাই ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, হতাশ এবং বিরক্ত যে প্রথম দিনের ত্রাণ তারা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এলাকার সংসদ সদস্য পাঠিয়েছে মনে করে। সাঁওতালদের বড় অভিযোগের আঙ্গুল তো তার বিরুদ্ধেই। খোলা আকাশের নিচে না খেয়ে, ভূমিহীন হয়ে, স্বজনহারা হয়েও সাঁওতালরা আত্মাভিমান বজায় রেখেছিলেন। এত ঘটনা ঘটে গেল স্থানীয় সংসদ সদস্য একবার উঁকি দিয়েও দেখলেন না তার এলাকার জনগণ কেমন আছে, কীভাবে আছে। নাকি সাঁওতালদের তিনি এদেশের মানুষ বলেই গণ্য করেন না! কে মানুষ? কে অমানুষ? কে হয় জানোয়ার?
‘এদেশেতেই জন্ম, এদেশেতেই বাস, কেউ হয় আদিবাসী, কেউ হয় দাস’। কেউ হয় হিন্দু— রাজনীতি তাদের নাম দেয় মালাউন। রাজনৈতিক দলের অন্তর্কোন্দল হয়, আর হামলা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। সুযোগ নেয় স্বার্থপর সুবিধাবাদী মানুষ। ফেসবুকের পোস্টের কি ক্ষমতা! রামু থেকে শুরু করে নাসিরনগর- সংখ্যালঘুরা ছাড় পায় না কোথাও। ধর্মীয় উন্মত্ততার বলি হয় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। দোষ তাদের একটাই— তাদের ধর্ম! নাকি দরিদ্রতা! নাকি এই দুটিই তাদের আজন্ম পাপ।
গরিব সাঁওতালদের পৈতৃক জমি চিনিকলের জন্য বরাদ্দ নেওয়া হয়েছিল, শর্ত ছিল চিনিকলের প্রয়োজনে না লাগলে জমি ফেরত দেওয়া হবে। একই যুক্তিতে স্থানীয় বেশ কিছু বাঙালি পরিবার বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও সাঁওতালদের জমি স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা ও চিনিকল কর্তৃপক্ষ বর্গা দিয়ে ও নানা উপায়ে ভোগদখল করছেন। সাঁওতালরা তাদের নিজেদের জমিতে বসতবাড়ি স্থাপন করলে পুলিশ তাদের উচ্ছেদের নামে হত্যা করে। সরকার তার প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করতেই পারে কিন্তু দরিদ্র সাঁওতালদের কোনো রকম নোটিস ছাড়া উচ্ছেদ আর উচ্ছেদের নামে গুলি আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রকেও বোধহয় হার মানিয়ে দেয়। কখনো জঙ্গি হামলা, কখনো কিশোর, তরুণদের ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করা, চাপাতির কোপ বা নির্বিচারে মানুষ খুন, স্বাধীন মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করে টার্গেট কিলিং, শিশু-নারীদের ওপর অমানবিক নৃশংসতা, কখনো হিন্দুদের বাড়িঘর মন্দিরে আগুন, কখনো আদিবাসীদের ওপর গুলিবর্ষণ, ক্ষণিক বিরতি দিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা এ কিসের আলামত!

আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে নানাবিধ সমস্যায় আমরা নিজেরাই জর্জরিত। আমরা কি আমাদের সামনে এমন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি যা আমাদের উৎসাহিত করে? নিউ মিডিয়া এক অপার সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে। কিন্তু সম্ভাবনাকে সমস্যায় রূপান্তরে তিলমাত্র দেরি করিনি আমরা। গ্লোবাল ভিলেজ বিশ্বকে একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত করেছে, যে গ্রামের প্রতিবেশীরা তার পাশের ঘরে উঁকি মেরেও দেখে না প্রতিবেশী ভুক্ত না অভুক্ত, জীবিত না মৃত। কিন্তু পাশের প্রতিবেশীর চলন-বলনের ত্রুটি ধরতে আমরা পিছপা হই না। মৃত বা আহতের পাশে প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে সেলফি আমরা তুলি, অন্যের ফেসবুকে, অন্যের সমালোচনায় আমরা মুখর হই। কিন্তু দুর্বলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমাদের সময়ের বড়ই অভাব। এ সমাজ উঠতে-বসতে আমাদের নিষেধের বেড়াজালে আটকে দেয়। মন্দ, ভালোর তকমা দেয়। তাহলে সেই সনাতন গোড়া সমাজ থেকে আধুনিক প্রযুক্তির ছটায় আলোকিত এ সমাজের পরিবর্তন কি ভার্চুয়াল জগতের মতোই বিভ্রান্তিময়, মিথ্যা?
বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা বদলে গেছে। অতি বর্ণবাদী ট্রাম্প আজ আমাদের মনের মুখোশ তুলে ফেলে সংকীর্ণতা, হিংসা, সব পঙ্কিলতা নিয়ে সামনে উপস্থিত। যা ছিল চোখের আড়ালে আজ তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু হিন্দুদের ওপর যখন অত্যাচার হয়, আদিবাসীদের ওপর গুলিবর্ষণ হয় আমাদের মনের ট্রাম্পকে তখন লুকাবে কে?
শুনেছি ক্রোধ মানুষকে অমানুষ করে। কিন্তু আমরা নিরীহ গা বাঁচিয়ে চলা ভীরু মানব সন্তানেরা কোন ক্রোধের বলে দেয়ালে মুখ লুকাই, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে অমানুষ হই! কোন প্রাণের লোভে নির্বিকার হয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চেয়ে দেখি। পরকালের ভয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার জেরে ইহকালকে ধ্বংস করি! সুস্থ সংস্কৃতি, দেশের প্রতি সম্মানবোধ, ভালোবাসা আজ বোধহয় সবই কাগুজে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভারত বিদ্বেষ, বর্ণবাদ, ধর্মীয় কুলীনতা আর কতকাল শুধু এ কয়টি শব্দকে পুঁজি করে বিভেদ বৈষম্য বাড়িয়ে যাব, ক্ষোভের দাবানলকে উসকে দিব? আর কতকাল! ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’— তবে কোন আতঙ্কে এই জন্মভূমি ছেড়ে ভিন দেশে পাড়ি জমাতে হয় এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে? কোন অধিকারে তাদের উচ্ছেদে আমরা বন্দুকের দাবানলে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেলি মনুষ্যত্বকে, মানুষকে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব সম্প্রদায়ের মানুষ নাগরিক হিসেবে নিরাপদে থাকবেন, মাথা উঁচু করে বাঁচবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।  কিন্তু বারবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি প্রমাণ দেয়!
সুনীলের কবিতার মতোই বলতে ইচ্ছে হয়—
এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল,
মানুষ তবু ছেলেমানুষ রয়ে গেল
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনো বুঝলো না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
‘মানুষ’ শব্দটাতে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই
ঈশ্বর নামে কোন বড় বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না
ধর্মগুলো সব রূপকথা
যারা এই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে
তারা প্রতিবেশীর উঠোনের
ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না
তারা গর্জন বিলাসী ...

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও
সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
http://www.bd-pratidin.com/editorial/2016/11/23/186956


Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment