গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে গত ৬ নভেম্বর দুপুরে আখ
কাটা নিয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে পুলিশ ও মিল কর্মচারীদের সংঘর্ষের পর
পরিকল্পিতভাবে সাঁওতালদের ওপর হামলা চালায় প্রশাসন। ওই দিন রাতে পুলিশ ও
র্যাব তাদের ওপর গুলি চালায় ও বাড়িঘরে আগুন দেয়। এতে তিন সাঁওতাল মারা
যান। শত শত সাঁওতাল পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) সাঁওতাল
পল্লী মাদারপুর চার্চ মাঠে গণশুনানিতে সাঁওতালদের পক্ষে বারনাবাস টুডু,
রাফায়েল হাসদা, রিনা মাইতি, কৃষ্ণ মুরমু, ববিতা মুরমু ও ভেরজুলিও হেমভ্রম
এভাবে ঘটনার বর্ণনা করেন।
সাঁওতালরা ১৯৫৫ সালে তাদের পূর্ব পুরুষের
ঘরবাড়ি ভেঙে ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি দখল প্রক্রিয়ার শুরু থেকে
বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন।রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ, হত্যা ও হামলার ঘটনায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ গণশুনানির আয়োজন করে। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হওয়া এ গণশুনানিতে উপস্থিত হয়ে সাঁওতালরা ঘণ্টাব্যাপী তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। গণশুনানি পরিচালনা করেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক বিচারপতি শামছুল হুদা।
এর আগে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে সাবেক বিচারপতি শামছুল হুদা, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বায়েজিদ আব্বাস, সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরীসহ ১৮ সদস্যের দলটি সাঁওতাল পল্লী ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
গণশুনানিতে সাঁওতালরা জানান, তাদের বাপ-দাদাদের জমি চিনিকল যখন নিয়ে নেয় তখন শুধুমাত্র জমিতে থাকা ফসলের মূল্য বাবদ টাকা দেওয়া হয়। জমির কোনও মূল্য দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে জমি অধিগ্রহণের কাগজপত্র করা হয়। জমিতে চিনিকলের জন্য আখ চাষ ছাড়া অন্য কোনও ফসল চাষ করা হলে জমি মূল মালিকদের ফেরত দেওয়া হবে বলে সেসময় চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে চিনিকলটি বন্ধ হয়ে যাবার পর স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের জমিগুলো লিজ দেওয়া হয়। যেখানে ধান, ভুট্টা, আলু, তামাক, গমসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করা হতো। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ মিলের জমিতে ৯টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ শুরু করেন।
তারা আরও জানান, এমন পরিস্থিতিতে ওই জমির মালিকানা ফিরে পেতে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন। যাতে এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদ বুলবুলের ইন্ধনও ছিল। বুলবুল ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি হয়ে প্রতি সপ্তাহের শনিবার সভা করে আন্দোলনের খরচ ও কাগজপত্রের কথা বলে পরিবার প্রতি দেড় থেকে দুইশত টাকা করে চাঁদাও তোলেন। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বুলবুল আন্দোলন থেকে সরে পড়েন।
তারা বলেন, তাদের জমি ছাড়ার জন্য পূর্বে কোনও রকম নোটিশ দেওয়া হয়নি। উচ্ছেদের পর এখন পর্যন্ত শত শত পরিবার খোলা আকাশের নিচে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সাঁওতালদের দাবি, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুযায়ী তাদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
গণশুনানিতে সাঁওতালরা দাবি জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বেআইনিভাবে উচ্ছেদে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেইসঙ্গে তারা আরও বলেন, সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি ছাড়া সরকারি খাস জমিতে তাদের পুনর্বাসন করার উদ্যোগ মেনে নেবে না।
শুনানি শেষে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘অধিগ্রহণ করা জমি অন্য কাউকে লিজ দেওয়ার অধিকার চিনিকল কর্তৃপক্ষের নেই।’
ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রয়োজনে আমরা আইনগত সহায়তা দেব। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পরিচালিত গনশুনানির রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়ে আপনাদের দাবি উপস্থাপন করা হবে।’
কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, সাঁওতালদের পুনর্বাসনসহ ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা এবং সাঁওতালদের নির্যাতন, হত্যা, লুট ও গুলির ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। জমির অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তাদের সঙ্গে থাকবে বলে তিনি সাঁওতালদের আশ্বস্ত করেন। পরে সহায়তা হিসেবে নগদ টাকা ও কম্বল বিতরণ করা হয়।
এদিকে, গত রবিবারে এক সংবাদ সম্মেলনে গাইবান্ধা জেলা প্রসাশক মো. আব্দুস সামাদ জানান, চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি সাঁওতালদের ফেরত পাবার কোনও সুযোগ নেই। কারণ সেসময় সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েই জমিগুলো অধিগ্রহণ করেছিল। আদিবাসীদের পক্ষে আদালতের নির্দেশনা পেলেই শুধু এর ব্যাতিক্রম সম্ভব। তারা রাজি হলে কাটাবাড়ি ইউনিয়নের ১৪.২৬ একর জায়গায় আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন সাঁওতালদের পুনর্বাসন করা যাবে।
এদিকে, ইক্ষু খামারের জমিতে সাঁওতালদের রোপন করা আমন ধান কাটার সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত করেনি সাঁওতালরা। তবে মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম ও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল জমিগুলো পরিদর্শন করেছেন।
জেলা প্রশাসক জানান, পরিমাপ করে দেখা গেছে ৪৫ দশমিক ৫০ একর জমিতে ধান
চাষ করা হয়েছে। হাইকোর্ট ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ধানকাটার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই
আদেশের একটি অংশে বলা হয়েছে ‘অধিগ্রহণকৃত জমিতে সাঁওতাল জনগোষ্ঠি যে ধান
চাষ করেছে, সে ধান সংগ্রহে তাদের সুযোগ দিতে হবে’। অপরাংশে বলা হয়েছে ‘যদি
প্রথমটি সম্ভব না হয় তাহলে সুগারমিল কর্তৃপক্ষ এ ধান সংগ্রহ করবে এবং
সম্পৃক্ত সাঁওতাল জনগোষ্ঠির কাছে তা হস্তান্তর করবে’। নির্দেশনা অনুযায়ী
সাঁওতালরা যদি ধান সংগ্রহ না করে তবে সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ধান কেটে তাদের
বুঝিয়ে দেবে।
কাটা ধান বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন,
ধান যদি কোনও সমিতির মাধ্যমে চাষ করা হয় সে ক্ষেত্রে সমিতিকে বুঝিয়ে দেওয়া
হবে। সমিতি না চাইলে যারা ধান চাষ করেছে তালিকা অনুযায়ী পৃথক পৃথকভাবে
তাদের ধান বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সেটাও সম্ভব না হলে স্থানীয় ওয়ার্ড পর্যায়ে
যারা জনপ্রতিনিধি আছেন তাদের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চালানো হবে। এ
পর্যায়েও যদি বিষয়টি নিস্পত্তি সম্ভব না হয়, তবে ধান শুকিয়ে খাদ্য বিভাগের
মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করে বিষয়টি আদালতকে জানানো হবে। এ বিষয়ে আদালত
পরবর্তীতে যে নির্দেশনা দেবেন তা বাস্তবায়ন করা হবে।এ প্রসঙ্গে ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও সাঁওতাল পল্লী মাদারপুরের গ্রাম প্রধান বার্নাবাস টুডু ও ভূমি উদ্ধার কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে জানান, কমিটির নামে সংঘবদ্ধভাবে রোপা আমন ধান চাষ করা হয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ধান কাটা হবে। তবে ধান কাটার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। সিদ্ধান্ত নিয়ে মিল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে অতি সত্তর জানানো হবে।
উল্লেখ্য, উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল পরিবারগুলোকে মঙ্গলবারও মাদারপুর মিশন গীর্জা সংলগ্ন খোলা মাঠ, গাছ-গাছালির আড়ালে এবং পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা গেছে। গত ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে তীরবিদ্ধ হন ৯ জন পুলিশ সদস্য এবং গুলিবিদ্ধ হন চার সাঁওতাল। নিহত হন আরও তিন সাঁওতাল। পরবর্তীতে পুলিশ-র্যাব ওই দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে। এ সময় তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে মালামাল লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা।
ওই সংঘর্ষের ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে ঘটনার দিন রাতে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩/৪শ’ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি দেখিয়ে মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে।
http://www.banglatribune.com/country/news/159361/%E2%80%98%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%93%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%93%E0%A6%AA%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%98%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%A8
0 comments:
Post a Comment