Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

সান্তালি ভাষার হরফ সমস্যা নিরসনে রাষ্ট্রের উচিত যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া

খোকন মুরমু
আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালি জাতির পাশাপাশি বসবাস করছেন অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। এসব জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও ভাষা। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৯ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ৫২'র ভাষা আন্দোলনে বাঙালির রক্তদানকে চিরস্মরণীয় করেছেন। একুশের এ চেতনা সারাবিশ্বের সব রাষ্ট্রকে নিজ দেশে নানান ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রাণিত করবে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভকারী বাংলা ভাষাভাষীর এদেশেই বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির ভাষা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অবাঙালি এসব মানুষ আজ নিজ দেশেই নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার দেরিতে হলেও আজ দেশের অন্যান্য জাতিসত্তার মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। এরই মধ্যে এসব জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করেছে বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত 'শিক্ষা নীতি-২০১০'। বাংলাদেশে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে 'জাতীয় শিক্ষা নীতিতে' মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের বিল পাস করেছেন। শিক্ষা নীতি-২০১০ বাস্তবায়নে সরকার ২০১৪ সাল শিক্ষাবর্ষের প্রথম থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সান্তাল, চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, মারমা, ম্রো ও ওঁরাও শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

গত ৭ সেপ্টেম্বর (২০১২) 'মণিপুরী ভাষা দিবস' পালন শীর্ষক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য এরই মধ্যে দিয়েছে এ নীতি বাস্তবায়নের সবুজ সংকেত। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, 'কাউকে ছোট বা কাউকে বড় নয়, বাংলাদেশের সব নাগরিকের শিক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য সরকার যুগান্তকারী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন। সরকার আজকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মায়ের কোলের পর নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুর ওপর জোর দিয়েছেন।' গত ৫ নভেম্বর ২০১২ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে 'ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণ' সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব। আলোচনায় সরকারের অন্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে চাকমা, সান্তাল, গারো, ত্রিপুরা, মারমা, ম্রো ও ওঁরাও জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় গৃহীত হয়, চাকমা, মারমা, ম্রো তাদের নিজস্ব লিপিতে এবং ত্রিপুরা, গারো শিশুদের জন্য রোমান লিপিতে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হবে। তংচঙ্গা জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি চাকমাদের সঙ্গে প্রায় মিল থাকায় এবং আপত্তি না থাকায় উভয় ভাষার জন্য চাঙমা হরফে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ণ করা হবে। সান্তাল ও সাদ্রী ভাষাভাষী শিশুদের জন্য উত্তরবঙ্গের সান্তাল এবং ওঁরাও উভয় প্রতিনিধি 'বাংলা' হরফে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। সান্তাল ভাষার জন্য ওই প্রস্তাব সভায় গৃহীত হয়নি। কারণ বাংলাদেশে সান্তালি লেখার ক্ষেত্রে রোমান হরফ বেশি জনপ্রিয়। এ আলোচনা সভায় সান্তাল প্রতিনিধিগণকে তাই সমাজের সঙ্গে বসে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

সান্তালি ভাষার জন্য হরফ বির্তকের এ জের ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ও রোমান হরফ এর সমর্থক সান্তালদের মধ্যে পরস্পরকে দোষারোপ, তর্কযুদ্ধ, সামাজিক মিডিয়ায় শোরগোল থেকে কাদা ছোড়াছুড়ি পর্যন্ত গড়িয়েছে ব্যাপারটা। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সংগঠনের মানববন্ধন, সমাবেশ ও জনমত তৈরির পদক্ষেপ আজ অবধি চলমান। 'বাংলাদৗশ্ম সান্তাল বাইসি' গত ১৭ জানুয়ারি ২০১৩ দিনাজপুর প্রেসক্লাবে রোমান হরফে সান্তাল ভাষা লেখার জন্য সংবাদ সম্মেলন করে। এর ধারাবাহিকতায় এ সংগঠনটি এখন অবধি রোমান হরফে সান্তালি ভাষা লিখার পক্ষে সান্তাল জনগণের মধ্যে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। 'জাতীয় আদিবাসী পরিষদ' গত ৯ জানুয়ারি ২০১৩ রাজশাহী শহরে বাংলা হরফে সান্তালি ভাষা লিখার জন্য মানববন্ধন করে। এ সংগঠনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন জাতীয় ছাত্র পরিষদ। এ সংগঠন দুটি সান্তালি ভাষা বাংলা হরফে লেখার জন্য জনসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।

সান্তালরা সাধারণত খ্রিস্টধর্ম ও সারি সারনা (সান্তালদের আদিধর্ম) ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকেন। আবার কিছু লোকজন সনাতন ধর্মের রীতিমাফিকও ধর্মচর্চা করে থাকেন। সারি সারনা অনুসারীরা যর্থাথভাবে ধর্মীয় চর্চা করেন বাংলাদেশে। এমন লোকজন খুবই কম। কারণ এ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ধর্ম-বই পুস্তকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সারনা ধর্মাবলম্বী অনেক সান্তাল সে কারণে প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে সনাতন ধর্ম পালন করে থাকেন। সারি সারনা এবং সনাতন ধর্মের অনেকটা মিল থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সারি সারনা অনুসারী সান্তাল শিক্ষার্থীরা আজ সনাতন ধর্ম শিক্ষাকে পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে। সারি সারনা ধর্মের ধর্মীয় বইপুস্তক, শিক্ষক এবং এর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কোনটাই বাংলাদেশে নেই। একটি সান্তাল শিশু জাতিতে সান্তাল হওয়া সত্ত্বেও সারনা কিংবা খ্রিস্টান ধর্মের যে কোন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করছে। খ্রিস্ট ধর্মানুসারী পরিবারে জন্মগ্রহণের ফলে প্রকৃতিগতভাবে রোমান হরফে সান্তালি সাহিত্য চর্চার জগতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সারি সারনা অথবা সনাতন ধর্মাবলম্বী একটি সান্তাল শিশু জন্মগতভাবে এ সুবিধাটা সাধারণত পাচ্ছে না। সে ছোট থেকে সারনা ধর্মের মজবুত ভিত হাতড়াচ্ছে সনাতন ধর্ম শিক্ষায় এবং খ্রিস্ট ধর্মকে মিশনারি প্রণীত ধর্ম বলে অবজ্ঞার চোখে দেখা শিখছে পরিবার থেকেই। ধর্ম শিক্ষার এ বিষয়টি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা প্রণেতাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন। সারি সারনা ধর্মের বইপুস্তক প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা হতে মাধ্যমিক পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

সান্তাল জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অনেকে গবেষণা করলেও সমস্যার গভীরে গিয়ে গবেষণা করেছেন মাত্র গুটিকয়েক গবেষক। এসব গবেষণার মধ্যে থাকা কিছু ছোট ভুলের জন্য সান্তালদের পরবর্তীতে গুনতে হয় বড় মাশুল। সেসব ভূল বিষয়গুলো বাঙালি সমাজ সহসাই গ্রহণ করে থাকে যা সান্তালদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অনেক ভালো গবেষক এ পর্যন্ত জানেন না সান্তালি ভাষার অভিধান আছে। সান্তাল সম্পর্কে স্বল্প অনুসন্ধান এসব গবেষণাপত্রের ওপর নেয়া জাতীয় পর্যায়ে অনেক সিদ্ধান্ত সান্তালদের স্বার্থের বাইরে চলে যায়। একাডেমিক কার্যক্রম সম্পাদন করতেও অনেকে সেকেন্ডারি তথ্যের ওপর নির্ভর করে গবেষণা সম্পন্ন করেন। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় পূর্ববর্তী গবেষণায় যদি কোন ভুলভ্রান্তি থেকে থাকে তা ভুলই থেকে যাচ্ছে। ড. ক্ষুদিরাম দাস রচিত 'সান্তালি বাংলা সমশব্দ অভিধান' খুবই ভালো মানের একটি গবেষণা যদিও বাংলা হরফে কিছু সান্তালি শব্দ পরিষ্কার নয়। মাতৃভাষা সান্তালি নয় কিন্তু বাংলা ভালো জানেন এমন লোক সান্তালদের নিয়ে কোন গবেষণার কাজ করলে উপাত্ত সংগ্রহে বইটি রাখা তার জন্য জরুরি। লেখক বইটি হয়তো বাংলাভাষী জনগণের সান্তালি ভাষা বোঝার মাধ্যম হিসেবে রচনা করেছিলেন। ড. বঙ্কেশ চক্রবর্তীর 'এ কম্পেরাটিভ স্টাডি অফ সান্তালি অ্যান্ড বেঙ্গলি' প্রবন্ধটি সান্তালি ভাষায় বাংলার প্রভাব কতখানি এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে। অধ্যাপক জিনাত ইমতিয়াজ আলী সান্তাল স্টুডেন্ট্স ইউনিয়ন (সাসু) কর্তৃক প্রকাশিত সান্দেশ ৬ষ্ঠ বর্ষ, নবম সংখ্যা (২০০০) 'সাঁওতালি ভাষা : একটি পরিচিতিমূলক প্রচেষ্টা' প্রবন্ধে লিখেছেন এঙ্গা কুলের অর্থ (পুরুষ সিংহ) আন্ড্য়া কুলের অর্থ (নারী সিংহ)। প্রকৃতপক্ষে সান্তালি এঙ্গা শব্দের বাংলা অর্থ হবে স্ত্রীলিঙ্গ এবং সান্তালি আন্ড্য়া শব্দের বাংলা অর্থ হবে পুংলিঙ্গ। বদরুদ্দীন উমর কর্তৃক রচিত 'সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা' বইটির ২৩ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় লেখা হয়েছে 'সান্তালি ভাষায় নির্বিশেষ শব্দের সংখ্যা হাতেগোনা'। এটা ভুল তথ্য। কারণ সান্তালি ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং আজ অবধি চলমান। সান্তালি ভাষায় নির্বিশেষ শব্দের ব্যবহার কম থাকতে পারে কিন্তু হাতেগোনা নয়। পিও বোডিং কর্তৃক (১৯২৯-৩৬) সালের মধ্যে রচিত প্রথম পাঁচ খ-ের 'এ সান্তাল ডিকশনারি্থ বইটি দেখলেই বুঝা যাবে সান্তালি ভাষায় নির্বিশেষ শব্দ কতখানি আছে। অনেকে গবেষণায় সান্তালি ভাষাকে বেইজ হিসেবে ধরে বাংলা ভাষার শেকড় সন্ধানের জন্য গবেষণা করেন। ফলে না হয় সান্তালি ভাষার জন্য ভালো বা বাংলা ভাষার জন্য। সান্তালি ভাষার গবেষণা করতে হলে শিকড় অনুসন্ধানে যাওয়া প্রয়োজন তবেই বাংলা ও সান্তাল ভাষা উভয় লাভবান হবে।

বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র রচনা করেন পর্তুগিজ পাদ্রি মানুয়েল দ্য এসেম্পসাঁও এবং আরেক পাদ্রি উইলিয়াম কেরি রচনা করেন বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার প্রথম ব্যাকরণ বই। বাংলা ভাষার জন্য প্রথম ব্যাকরণ বই এবং সংবাদপত্র প্রণেতা খ্রিস্টান পাদ্রিদের বাংলা ভাষাভাষী লোকজন যথাযথ মর্যাদা দিয়েই স্মরণ করে থাকেন। বাংলা ভাষার পথিকৃৎ হওয়ার জন্য তাদের নাম বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু উপমহাদেশে এ দুই পুরোহিতের আবির্ভাব হয়েছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। এখানে ধর্ম মুখ্য নয়, দুজনের উদ্ভাবনের কাছে বাঙালি জাতি ঋণী থাকবে চিরকাল। বাংলা ভাষাভাষী কেউ উইলিয়াম কেরি রচিত বাংলা ব্যাকরণকে খ্রিস্টানদের উপাদান বলে অবজ্ঞা করছে না। একইভাবে সান্তাল ভাষার জন্য নরওয়েজিয়ান পুরোহিতদের অবদান অনেক বেশি। পিও বোডিং কর্তৃক রচিত অভিধান তাই আজকে সান্তালদের অভিধান। ঔপনিবেশিক শাসনের দলিল বলে অনেকে রোমান হরফকে বর্জন করার পক্ষে যুক্তি দেখালে তা অন্ধত্ব ছাড়া কিছু নয়। মিশনারিরা বহু দূর থেকে এসে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নিমিত্তে সান্তালদের হরফ, শব্দ ও ভাষা শুদ্ধভাবে শিখে তাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন ১৮০০ সালের প্রথমদিকে। সান্তালরা মিশনারিদের গবেষণা মনেপ্রাণে নিয়েছিল কারণ তাদের গবেষণায় ছিল আত্মত্যাগ। বাইবেল রোমান হরফে সান্তাল ভাষায় অনুবাদ হলে রোমান সান্তালি হরফ কালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মিশনারিদের প্রভাবে সান্তালরা অনেকে ধীরে ধীরে খ্রিস্ট ধর্মানুসারী হতে থাকে।

এটা সত্য, মিশনারিরা সান্তালদের বিভিন্ন মতবাদ চাপিয়ে দিয়েছে। মতবাদ হতে পারে ধর্ম বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। কিন্তু মিশনারিদের ধর্ম প্রসারের ফলে সান্তালি ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। ভাষার উপরে তারা কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। উপরন্তু তাদের আত্মত্যাগ সান্তাল জাতিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন অগ্রসর করেছে তেমনি সান্তালি ভাষাকেও করেছে আরও সমৃদ্ধশালী। উপমহাদেশে রোমান হরফে সান্তালি ভাষায় সাহিত্য চর্চা ও বিভিন্ন ধর্মীয় বইপুস্তক তৈরি করা শুরু হয় আঠার শতকের প্রথম দিক থেকে। মিশনারিরা সান্তালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেয়ার জন্য পড়াশোনা শেখাতে আরম্ভ করেন বাংলা হরফ দিয়েই। কিন্তু সান্তালি ভাষা বাংলা হরফে শুদ্ধ উচ্চারণ না হওয়ায় তারা প্রাথমিকভাবে সমস্যায় পড়েন। সান্তালদের পড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ইতিহাস, গান, ধাঁধা, উপকথা ও মিথ সংগ্রহ করে রেভা. জে ফিলিপস ১৮৪৫ সালে বাংলা হরফে সান্তালি ভাষার বই প্রকাশ করেন। সান্তালদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাথমিকভাবে বাংলা হরফে শুরু হলেও উচ্চারণ শুদ্ধ না হওয়ায় জন্য মি. ফিলিপস রোমান লিপিতে শুদ্ধভাবে সান্তালি ভাষা লেখার অনুশীলন চালাতে থাকেন। অবশেষে ১৮৬৩ সালে মিশনারিদের অনেক অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে তাদেরই উত্তরসূরি ড. সি আর লেপসাস সান্তালি ভাষার জন্য মানসম্পন্ন রোমান হরফ তৈরি করতে সক্ষম হন। এ রোমান হরফ আজ ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও উত্তরপ্রদেশে এবং নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়।

বেসরকারি মতে, বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ সান্তাল বসবাস করেন। বাংলাদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ সান্তাল রোমান হরফেই সান্তালি ভাষা চর্চা করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। কিছু এনজিও দাতা সংস্থার অর্থায়নে সান্তালি ভাষা শিক্ষার বই বাংলা হরফে প্রণয়ন করে নিজেদের পরিচালিত স্কুলে সান্তাল শিশুদের পড়ানো শুরু করেছে বিগত কয়েক বছর ধরে। এনজিও কর্তৃক বাস্তবায়িত এসব প্রকল্প বাংলাদেশের সান্তালদের আজ ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে দু'ভাবে বিভক্ত করেছে। রোমান হরফ বাংলাদেশে অবস্থানরত সান্তাল জনগণের কাছে সর্বজনীন হলেও কিছু সান্তাল এ হরফকে ধর্মবিদ্বেষের কারণে মনেপ্রাণে এখনও গ্রহণ করতে পারেনি। এটা তাদের মনস্তাত্তি্বক সমস্যা। রোমান হরফের সঙ্গে ইংরেজি হরফের মিল থাকায় এবং বিশ্বে ইংরেজি একটি প্রচলিত মাধ্যম হওয়ার কারণে আজ ইংরেজি শিক্ষার প্রসারতা ব্যপক। বিশ্বের প্রত্যেকটি অঞ্চলে ইংরেজি চর্চা বাধ্যতামূলক থাকায় এবং বাংলাদেশেও শিশু শিক্ষা থেকে এর প্রচলন থাকাই সান্তাল শিশুরা অল্প বয়সেই রোমান সান্তালি হরফ আয়ত্ত করতে পারে। সান্তাল শিশুরা এর ফলে সহজেই রোমান হরফে সান্তাল বর্ণমালা আয়ত্ত করে এবং লিখতেও শিখে। ইতিমধ্যে রোমান হরফে সান্তালি ভাষা ইন্টারন্যাশনাল ফনেটিকস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে। সমর মাইকেল সরেনের সান্তালি ভাষার টাইপিং সফটওয়ারের কল্যাণে সারা পৃথিবীতে সান্তালরা খুব সহজেই রোমান হরফে সান্তালি ভাষা চর্চা করতে পারবে। সামাজিক মিডিয়া, টুইটার ও ইন্টারনেটের কল্যণে এক দেশের সান্তাল জনগণ বুঝতে পারবে অপর মহাদেশের সান্তালদের মনন, প্রজ্ঞা, কথাসাহিত্য, হারানো গীত, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ইত্যাদি। সান্তালি সাহিত্যের ভিত হয়ে উঠবে আরও শক্ত, পরিষ্কার, যুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য। সান্তালি সাহিত্য জগতে আমূল পরিবর্তিন ঘটাতে পারবে রোমান হরফই।

সান্তালি বর্ণমালা নিয়ে বির্তক আসলে নতুন নয়। বর্ণমালা নির্ণয়ে বির্তকের এই জের বহু পুরনো। উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন আমল থেকেই শুরু হয় সান্তালি ভাষার জন্য উৎকৃষ্ট হরফের অনুসন্ধান। উপমহাদেশে রোমান, অলচিকি, বাংলা, দেবনাগরী, উড়িয়া বিভিন্ন বর্ণমালায় সান্তালি ইতিহাস, উপকথা, গান, ধর্মগ্রন্থ, সাময়িকী ও সাহিত্য ইত্যাদি বেশ কয়েক শতক আগে থেকেই প্রকাশিত হয়ে আসছে। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ বিতাড়িত আন্দোলনে সান্তালদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়েছে ঠিকই কিন্তু সহজ-সরল সান্তালদের জীবনে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বহু জাতির মধ্যে সান্তালদের বসবাস। বাংলাদেশে সান্তালদের একটি বৃহৎ অংশ বসবাস করে। ভারতীয় রাজনীতির শিকার সান্তালরা আজকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন হরফে নিজ মাতৃভাষা সান্তলি চর্চা করেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সান্তালদের বসবাসের কারণে সান্তালি ভাষা চর্চায় হরফ রাজনীতির হাতিয়ার হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার কখনো সান্তালদের এ হরফের ইস্যুতে সঠিক ও মজবুত কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। আজ অবধি ভারতে নানা বর্ণমালায় এর ব্যবহার লক্ষণীয়। বাংলাদেশে সরকারের উচিত হবে, সান্তালদের এ হরফ সমস্যাকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে সঠিক হরফে সান্তালি দোভাষী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ প্রণয়ন করা।

বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রণীত 'শিক্ষানীতি-২০১০' অনুচ্ছেদ নং- ১৮, ১৯ ও ২০-এ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের জন্য নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সুন্দর কৌশল অবলম্বন করার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে। একমাত্র সরকারের সুস্থ পরিকল্পনাই পারে দেশের কোন পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মূল স্্েরাতের মধ্যে নিয়ে আসতে কিন্তু এলক্ষ্যে সরকারকে যথেষ্ট যত্নবান হয়ে কাজ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে দাতাসংস্থা এবং এনজিওগুলোরও উচিত হবে সরকারের এ মহান উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে ভিশন-২০২১ স্বার্থক করে তোলা। সান্তাল শিশুদের শিক্ষা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এ রকম এনজিও উচিত এ জনগোষ্ঠী নিয়ে ভালোভাবে বিস্তারিত জেনে-বুঝে সরকারের সহায়তায় তাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। সরকার এবং এনজিওগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়া এক্ষেত্রে সান্তাল জনগোষ্ঠীর ভাষার হরফ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখবে। পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য শিক্ষার এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সেসঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন কৌশলপত্রের যেমন এমডিজি বা পোস্ট-এমডিজি ও পিআরএসপির মধ্যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বাংলাদেশ সরকার এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন শিশুমৃত্যুর হার কমানো, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার, মাতৃস্বাস্থ্য উন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফল হয়েছে ঠিকই। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগণের জীবনযাত্রায় কিন্তু এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আদৌ সফল হয়নি। পরিশেষে রাষ্ট্রের উচিত অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের 'বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন' বইয়ের (১৫৮)নং পৃষ্ঠার উদ্ধৃতিটুকুর সঠিক পরিচর্যা নেয়া। 'বাংলাদেশে আমাদের বাংলা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অবাঙালি জাতিত্তার যেসব ভাষা রয়েছে সেসব আদিবাসী ভাষা যেমন- চাকমা, মারমা, গারো, খাসি, সান্তাল, ত্রিপুরা, ওঁরাও প্রভৃতির প্রতি বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, বাংলা ভাষীদের জাতীয় কর্তব্য প্রতিবেশী আদিবাসী ভাষাগুলোকে বিকাশে সহায়তা করা। বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে বাংলা ও অন্য যেসব ভাষা সহাবস্থান করেছে, বাংলা ভাষা এ দেশের যেসব আদিবাসী ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় অগ্রণী হওয়া বাংলাভাষীদের দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শিক্ষা পৃথিবীর প্রতিটি মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া; আপন আপন মাতৃভাষার প্রতি যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর মাতৃভাষার প্রতি যত্নশীল হওয়া। অন্য কোন ভাষা যেন আমার ভাষাকে গ্রাস করতে না পারে। আমার ভাষাও যেন অপর কোন ভাষাকে গ্রাস না করে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, আমরা আমাদের মাতৃভাষার প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল হব তেমনি বাংলাদেশের তথা বিশ্বেও ছোটবড় প্রতিটি মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও যত্নশীল হব।' অবহেলা ও বিদ্বেষ নয়, দেশের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলোকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে রাষ্ট্র এবং জনগণের সঠিক প্রচেষ্টাই পারে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল কিছু বয়ে আনতে।

[লেখক : সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, সান্তাল ষ্টুডেন্টস ইউনিয়ন]
 উৎসঃ http://www.thedailysangbad.com/index.php?ref=MjBfMDNfMThfMTNfMl8yM18xXzEyNjM0Ng==
******************************************************************
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment