নূসরাত খান, পার্বতীপুর (দিনাজপুর)
পোষা শালিকটিকে একটি শিশু গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। পরিপাটি মাটির ঘরের দাওয়ায় দু’জন আদিবাসী সাঁওতাল নারী অনেকগুলো ঝিনুক পরিষ্কার করছেন। একজন বৃদ্ধা, আর অপরজন মধ্যবয়স্কা। বললেন, ‘এটাই আমাদের রাতের খাবার। আগে বন-জঙ্গল ছিল, দু-চারটে শিকার পাওয়া যেত। এখন তো আর সেদিন নেই! তবু এখনো নদী-বিলে কিছু ঝিনুক পাওয়া যায়।’
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের কৃষিজীবী সান্তাল বা সাঁওতালরা এভাবেই এখন বংশপরম্পরায় প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করেন খাদ্য ও প্রটিনের পুষ্টি। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে বেঁচে থাকার অভ্যাস সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রাচীনতম ঐহিত্য।
এখনো তীর-ধনুকে শিকার মিশে আছে ব্রিটিশ রাজের সিংহাসন কাঁপানো সিঁধু-কানহুর উত্তরসুরীদের রক্তে। আলাপকালে তারা নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’র এই প্রতিনিধিকে জানান, সাধারণত শীতের শুরুতে দু-তিন দিনের জন্য ছোট ছোট দলে সাঁওতালরা বের হন শিকারে।
‘এখন তেমন ঘন বন-জঙ্গল নেই। তবুও আশপাশের ঝোপঝাড়ে আমরা শিয়াল, বেজী, বনবিড়াল শিকার করি’, বললেন স্থানীয় বুকচি গ্রামের কৃষক ফিলিপ মুর্মু।
প্রকৃতি ও আদিবাসী গবেষক পাভেল পার্থ নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে জানিয়েছেন, প্রকৃতপূজার সাঁওতালি আদি ধর্ম ‘শারণা’ (সত্য)। এই ধর্মের রীতি অনুযায়ী সহস্র বছর ধরে পালিত হচ্ছে ‘সোহরাই’, ‘বাহা’ বা ‘কারাম’ পূজার মতো প্রাচীন উৎসব। কিন্তু মিশনারীদের সূত্রে এখন অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হওয়ায় সাঁওতাল জনপদে প্রকৃতিপূজার প্রাচীন অনুসঙ্গ ও উৎসব প্রায় সবই বাতিল হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘এখন বড়দিনকে ঘিরে চলে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বড় উৎসব ‘সোহরাই’। মাদলের বোলে চলে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান। উৎসবে ভাতের সঙ্গে নানান পদের খাবার ছাড়াও ভাত থেকে বানানো পানীয় ‘হাড়িয়া’র থাকে প্রাচুর্য। এছাড়া মহুয়া ফুলের রস দিয়ে তৈরি পানীয় ব্যবহৃত হয় বিয়ের উৎসবে। পূজা কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢাক-ঢোল বা শিঙ্গার বাজনা যেন এক অনবদ্য বিষয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এসব বাদ্যযন্ত্র।’
পাভেল পার্থ বলেন, ‘একসময়ের বনজীবী সাঁওতালরা এখনো বিয়ে বা পূজায় শালপাতার নানা অনুসঙ্গ ব্যবহার করেন। তাদের কাছে ঐক্য আর সংহতির প্রতীক শালগাছ। তবে এখন বন কমে যাওয়াতে বিভিন্ন উদযাপনে শালপাতার পরিবর্তে আমপাতা ব্যবহৃত হচ্ছে।’
আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে জানান, দিনের পর দিন ভূমি হারিয়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর সাঁওতালরা জীবিকার তাড়নায়, জীবন বাঁচাতে পাড়ি জমাচ্ছেন ওপারে ভারতে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাঁওতালরা কখনোই দরিদ্র ছিল না। ভূমি দস্যুরা মিথ্যে মামলা দিয়ে, জাল দলিলপত্র করে, জবর-দখলের মাধ্যমে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। জমির জন্য সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, মুণ্ডাসহ উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের মামলা-হামলা ছাড়াও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, ধর্ষন করা হচ্ছে, খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। ভূমিহীন হতে হতে অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার কোনো না কোনো গ্রাম থেকে নিয়মিতভাবে আদিবাসী পরিবার দেশান্তরী হয়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন। আদিবাসী এমন অনেক পরিবার আছেন, যারা জমি-জমা হারিয়ে এখন নিজের জমিতেই দিনমজুরি করছেন।’
সাঁওতাল কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালেও মেলে এসব কথার সত্যতা। তারা জানান, সাঁওতালরা সরকারি নিয়মে জমি নিবন্ধন করেছেন বটে, কিন্তু বহুভাবেই তা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এরপরেও ভীষণ কষ্টে নিজেদের সংস্কৃতি যতটুকু সম্ভব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।
জমির ওপর আদিবাসীর অধিকারের প্রশ্নে সাঁওতাল কৃষক ফিলিপ মুর্মু’র কণ্ঠে হতাশা ছড়ায়। তিনি বলেন, ‘আগাম নোটিশ ছাড়াই একদিন হঠাৎ করেই আমাদের জমি ‘খাস’ হয়ে যায়। এরকম ঘটনা বহু আছে।’ তিনি জানান, তার ১৪ বিঘা জমি বনবিভাগের আওতায় চলে যাওয়ার পরও তিনি খাজনা দিয়ে যাচ্ছেন। মামলা হয়, মামলার রায়ও তার পক্ষে আসে, কিন্তু জমি আর হাতে আসেনা।
ফিলিপ জানান, কিছুদিন আগে পার্বতীপুরের আরেক গ্রাম চিরাকুঠায় সাঁওতালদের বাড়িঘর দখল করে তাদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত পর্যন্ত করা হচ্ছে। এছাড়া বছর দুয়েক আগে বুকচি গ্রামে এক প্রভাবশালী মহল জমি দখলের পায়তারা চালাতে চাইলে সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে নিজেরাই তাদের প্রতিহত করেছেন। কিন্তু সংখ্যায় কম থাকলে সেসব এলাকায় সব সময় আর তা হয়ে ওঠে না।
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/এনকে/বিআর
Source:http://bangla.newsnextbd.com/article206562.nnbd/#sthash.Sd61hA5s.gbpl&st_refDomain=www.facebook.com&st_refQuery=
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment