Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে : আদিবাসী সমাজের এক বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব

অরুণ চৌধুরী

ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের গত ২১শে ফেব্রুয়ারি জীবনাবসান হয়েছে। তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। অবিভক্ত মেদিনীপুরের লালগড়ের ভীমপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। ভীমপুর গ্রামের খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলে তাঁর বাবা শিক্ষকতা করতেন। ধীরেন বাস্কের লেখাপড়া ঐ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পরে সে উচ্চশিক্ষার জন্য আসে শ্রীরামপুর কলেজে। শ্রীরামপুর কলেজ বিখ্যাত খ্রিস্টান মিশনারি উইলিয়াম কেরী মার্শ মেন ওয়ার্ড দ্বারা ১৮১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে খ্রিস্টানদের ধর্মশাস্ত্র পড়ার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল। তাছাড়া সাধারণ বিভিন্ন বিষয়েও পড়ানো হতো। খ্রিস্টান ছাত্রদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল। ধীরেন বাস্কে সেই হিসাবেই এখানে পড়তে আসে। থাকত ‍হস্টেলে, সেখানে কিছু ছাত্র তাঁর প্রতি অবহেলা ও অত্যাচার করতো। ক্লাসেও তাঁকে এক বেঞ্চে বসতে দিত না। হস্টেলে সমর বসু নামক এক সহপাঠী ছিল। সমর বসুর বাবা শ্রীহট্টের এক চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। সমর বসু এবং আমি ধীরেন বাস্কেকে প্রথম বেঞ্চে বসার সু‍‌যোগ করে দেই। হস্টেলে ধীরেনের উপর অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সমর সবসময় ধীরেনের পাশে দাঁড়াত। তখন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন এঙ্গাস নামে একজন স্কটিশ। আমরা একদিন ধীরেনের উপরে অত্যাচার নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করতে বাধ্য হই। হস্টেল সুপার ছিলেন অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ দাস, তাঁর কাছেও আমরা নালিশ করি। যার ফলে, ধীরেনের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়। ধীরেন শ্রীরামপুর কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে শিক্ষকতার জীবন গ্রহণ করে। কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর ধীরেন রাজ্য সরকারের তথ্য বিভাগে চাকরি নেয়। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ তৈরি হলে, ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকার একটি সাঁওতালি সংস্করণও প্রকাশিত হয়। ধীরেন ঐ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদিবাসী কল্যাণ বিভাগের উন্নয়ন নিগমের প্রকাশনার দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্য লোক সংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি পর্ষদের জন্ম হলে, ধীরেন তার অন্যতম সদস্য হয়।

বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সাঁওতাল আকাদেমি প্রতিষ্ঠিত হলে ধীরেনকে তার সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। বামফ্রন্ট সরকারের আদিবাসী কল্যাণমন্ত্রী উপেন কিসকু ছিলেন সভাপতি। ঐ দায়িত্ব পাবার পরে ধীরেন উপেন কিসকুর সহায়তায় নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে বিশ্ববিখ্যাত সাঁওতালি ভাষা ও সংস্কৃতির পণ্ডিত, পি ও, বোডিং-এর যেসব মূল্যবান সংগ্রহ আছে তার ফটোকপি ঐ আকাদেমিতে আনার ব্যবস্থা করে। ঐ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন অধ্যাপক ড. এন্ডারসন। পরবর্তীকালে রাজ্য সরকার তার কিছু অংশ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের পরবর্তীকালে সেই কাজ এক বিন্দু অগ্রসর হয়নি। রাজ্য সরকার কর্তৃক সাঁওতালি ভাষা সম্পর্কে যে পবিত্র সরকার কমিশন গঠিত হয়েছিল তারও অন্যতম সদস্য ছিল ধীরেন বাস্কে। সাঁওতালি ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সারা জীবনব্যাপী ধীরেন বাস্কে গবেষণা করেছেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস, সাঁওতাল গণসংগ্রাম তার অবিস্মরণীয় কীর্তি। তাছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ অধিবাসী সমাজ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রাক্‌বৈদিক সমাজ, সাঁওতালি মেন কথা আত ভেনতা কথা সাঁওতালি বিন্‌তি, কারাম বিনতি হড় রড় বায়ান তৌদি (সাঁওতালি ব্যাকরণ), সাঁওতাল গণসংগ্রামের নারী সমাজের ভূমিকা। বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী হড় বাপলা সেরেঞ পুঁথি, আদিবাসী রূপকথা প্রভৃতি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন।

তিনি বীরষা মুণ্ডা পুরস্কার, সাধুরাম চাঁদ মুর্মু পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন পুরস্কার। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্মানিক ডি-লিট, তাপসী বসু স্মৃতি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি-লিট, রাজ্য সরকারের লোক সংস্কৃতি উৎসব, ২০০৭-সহ বিবিধ সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়েছেন।

তিনি তফসিলী সমাজের এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী অনিতা বাস্কে শিক্ষিকা ছিলেন। কয়েকবছর আগে তাঁর স্ত্রী-বিয়োগ হয়। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। তাঁরা ঝাড়খন্ডের এক আদিবাসী শিশুকে পুত্রবৎ লালনপালন করেন। তাকে লেখাপড়া শেখান এবং বিয়েও দেন। তার কলকাতার টালিগঞ্জের রানীকুঠির বাড়িতে। বহু আদিবাসী ছেলেরা থেকে পড়াশোনা করতো।

১৯৪৭-৪৮’এ আমরা এক সঙ্গে পড়াশোনা করি। তারপর আমি চলে যাই বঙ্গবাসী কলেজে। ধীরেন শ্রীরামপুর কলেজেই রইলো। সেখান থেকেই বি এ পাস করলো। তারপর তার শিক্ষক জীবন শুরু। সে প্রথমে ভীমপুর হাইস্কুলে পরে বিষ্ণুপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে। তারপর সে রাজ্য সরকারের অধীনে চাকরি নেয়। তার চাকরি জীবনের ইতিবৃত্ত আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি।

ছাত্র জীবনে তার সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পরেও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। মাঝখানে কিছুদিন বাদ দিলেও সেই যোগাযোগ স্থাপিত হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। সে তখন সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস রচনা করে। তা দেখে তাকে আমি চিঠি লিখি। সে উত্তর দেয়। এভাবেই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ঝালাই হয়।

১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। শ্রদ্ধেয় সুধীপ্রধানের উদ্যোগে রাজ্য সরকার গড়লো রাজ্য লোকসংস্কৃতি পর্ষদ। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন তথ্যমন্ত্রী। আমাকে ঐ পর্ষদের সদস্য করা হলো। সদস্য তালিকায় দেখলাম ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের নামও আছে। উভয়ে ফের দেখা হলো। এর পরবর্তীকালে রাজ্য লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ধীরেন্দ্র বাস্কে তারও সদস্য হয়। আমিও সেই কেন্দ্রের অন্যতম সদস্য ছিলাম। সেজন্য বিভিন্ন সভায় ও অনুষ্ঠানে দেখা হতো।

আমরা সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মরণে ১৯৮০ সালে সিউড়িতে সিধু কানু উপজাতি সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করি। ঐ সংস্কৃতি কেন্দ্র পরবর্তীকালে সিধু কানু সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হিসাবে পরিণত হয়। সিউড়ির পুরানো সার্কিট হাউসে ঐ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু। ১৯৮০ সালের ৩০শে জুন ঐ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতিবছর ৩০শে জুন ও ১লা জুলাই ঐ কেন্দ্রে ‘হুল দিবস’ উদ্‌যাপিত হয়। নব্বইয়ের দশকে হুল দিবসের অনুষ্ঠানে ধীরেন্দ্র বাস্কে উদ্বোধক হিসাবে সস্ত্রীক সিউড়ি আসে। ১৯৯৫ সালে ধীরেন সিধু কানুর জন্মস্থান দেখার জন্য আমার সহযাত্রী হয়। ঐ যাত্রায় আমরা সস্ত্রীক যাই। প্রথম যাই পাকুড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহের কাহিনীর প্রথম ভারতীয় রচয়িতা প্রয়াত দিগম্বর চক্রবর্তীর বাড়িতে আমরা অতিথি হই। সেখান থেকে আমরা ভগনাডিহিও পাঁচকেঠিয়ায় যাই। ফেরার পথে আমরা আমবাড়ি ও পাড়ের কোলা হয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত মহেশপুরে আসি। আমবাড়িতে পুরানো ভুঁইয়া রাজাদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ আছে। আছে বিস্তীর্ণ আমবাগান। পাড়েরকোলায় সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক শ্যামপরগনায়েতের বাড়ি তার কয়েকবিঘাব্যাপী দুর্গের মতো খড়ের বাড়ি।। ঐ বাড়িতেই শ্যামপরগনায়েত ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে গুলি বিদ্ধ হয়ে নিহত হন। শ্যামপরগনায়েতের গুলিবিদ্ধ বিপুল বপু দেখে বীরভূমের তদানীন্তন কালেক্টর ইডেন স্তম্ভিত হয়েছিলেন। ইডেন তার হাতের বন্দুক নামিয়ে রেখে শ্যামপরগনায়েতকে সেলাম জানান।

সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়ে বর্তমান সাঁওতালদের সমস্ত বাড়িঘর ভস্মীভূত বা ধূলিসাৎ করা হয়। কিন্তু শ্যামপরগনায়ে‌তের ঘরবাড়ি পোড়াতে বাধা দেন ইডেন। যার ফলে সেই ঘরবাড়ি এখনও বলবৎ আছে। তাই, সেদিনের একমাত্র স্মারক।

স্ত্রী-বিয়োগের পরে ধীরেন মনবেদনায় লেখাজোকা ছেড়ে দেয়। তারপর লেখাজোকা করার জন্য তাকে বহুবার বলি। এরপর তার আবার লেখাজোকা শুরু হয়। দেশহিতৈষীতে ‘কলিকাতার সাঁওতাল সমাজ’ নামক এক মূল্যবান প্রবন্ধ লেখে।

ধীরেনের কলম থেমে গেল। আর কোনোদিন তাঁর দ্বারা লেখা হবে না। কিন্তু তাঁর পাণ্ডুলিপি রইলো। রইলো বহুসংগ্রহ। কিভাবে সেগুলি রক্ষিত হবে, তা আমাদের ভাবা দরকার।

ধীরেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি কখনও করেনি। সে ছিল উদারমনা একজন গণতান্ত্রিক মানুষ। জঙ্গলমহলের রক্তাক্ত ঘটনায় সে ব্যথিত হয়। প্রচারের প্রভাবে সে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি বীতরাগও হয়। তারপর আবার বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি তার বিশ্বাস ফিরে আসে। ঐ নিয়ে শেষ জীবনে আমার সাথে নিয়মিত কথাবার্তা হতো। ২০১০ সালে আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে একমাস শয্যাশায়ী থাকার সময় সে আমাকে দেখতে আসে। সেই শেষ দেখা। ২০১১ সালের নির্বাচনের পরে রাজ্য লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। ধীরেন ও আমি উভয়েই সদস্যপদ ত্যাগ করি। তাই, সেখানকার দেখা সাক্ষাতেরও সু‍‌যোগ রইলো না। তার মতো একজন উদারমনা গণতান্ত্রিক মানুষের বিয়োগব্যথায় মনে লাগছে। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাঁর মতো ভারতের অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া সমাজের একজন বিদগ্ধ মানুষ বিরল।

 Source: http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=52584

Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment