মোঃ মামুন চৌধুরী ॥ চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা-বাগানের বাসিন্দা
হীরামনি সাঁওতাল (৮৭)। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের লালসার শিকার
হয়েছিলেন তিনি। এজন্য তার নামের পাশে যুক্ত হয় বীরাঙ্গনা। সবার ত্যাগে দেশ
স্বাধীন হয়। তার (হীরামনি সাঁওতাল) শেষ ইচ্ছা ছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যেন
তার শেষ বিদায় হয়। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণে তেমন কেউ এগিয়ে আসছিলেন না। তার
ইচ্ছা পূরণের আশায় কেটে যায় প্রায় ৩৫টি বছর।
এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ত্যাগী বীরাঙ্গনা হীরামনি সাঁওতালসহ ৬ নারীর
সন্ধান পান বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর কন্যা এমপি কেয়া
চৌধুরী। ২০০৬ সালে কেয়া চৌধুরী ত্যাগী ৬ নারীর মুক্তিযোদ্ধার অধিকার আদায়ে
কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে কেয়া চৌধুরী ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক
মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ৬ বীরনারীদের মুক্তিযোদ্ধা
হিসাবে গেজেটভুক্ত করার কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন।
স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন ফারিজা খাতুন, মালতি রানি শুক্লবৈদ্য,
পুষ্পরাণী শুক্লবৈদ্য, রাজিয়া খাতুন, হীরামনি সাওতাল ও সাবেত্রী নায়েক। এর
মধ্যে বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পাওয়া হীরামনি সাঁওতাল ৩ মার্চ
বৃহস্পতিবার ভোরে নিজ বাড়িতে মারা গেছেন। এ সংবাদ জানার পরই হীরামনির
বাড়িতে ছুটে যান এমপি কেয়া চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা রাজিয়া খাতুন, সাবিত্রী
নায়েকসহ বিভিন্ন স্তরের লোকেরা। এমপি কেয়া চৌধুরী নিজ হাতে হীরামনি
সাঁওতালকে সমাহিত করার সকল ব্যবস্থা করেন। পরে দুপুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়
দেশের প্রথম নারী চা-শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা হীরামনি সাঁওতালকে সমাহিত করা
হয়েছে।
এ ব্যাপারে এমপি কেয়া চৌধুরী বলেন- যে হাতে হীরামনির ইতিহাস লিখে
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলাম। সে হাতেই আজ (৩ মার্চ) তাকে
লাল-সবুজের পতাকায় মুড়িয়ে বিদায় জানিয়েছি। হীরামনি’র মৃত্যু মেনে নিতে
কষ্ট হচ্ছে। যা কাউকে বলে শেষ করতে পারব না। তারপরও বলছি তার শেষ ইচ্ছা
পূরণ করতে পেরেছি।
হীরামনি সাঁওতালের সংগ্রামী জীবন যেভাবে কেটেছে ঃ
হীরামনির জন্ম মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার হুগলিছড়া চা বাগানে। তার
বাবার নাম অর্জুন সাঁওতাল। অর্জুন সাঁওতালের ২ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে
হীরামনি দ্বিতীয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রায় ২ মাস পূর্বে তার বিয়ে হয়
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা বাগানের চৌকিদার লক্ষণ
সাঁওতালের সঙ্গে। প্রথম স্ত্রী লক্ষী সাঁওতালের মৃত্যু হলে লক্ষণ হীরামনিকে
বিয়ে করেন। লক্ষী সাঁওতালের ৮ মাসের ছেলে গণেশকে আপন করে নিয়ে সংসার পাতেন
হীরামনি।
হীরামনির স্বামী লক্ষণ সাওতালের মা-বাবা কেউই জীবিত ছিলেন
না। অভিভাবক বলতে ছিলেন কাকা বিপীন সাঁওতাল। তিনি নানা কাজে হীরামনিকে
সহায়তা করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বৈশাখ মাসের কোন এক সকালে পাঞ্জাবিরা
বাগানের স্থানীয় এক চা শ্রমিকের স্ত্রীকে ধাওয়া করে। তখন সে আত্মরক্ষায়
দৌঁড়ে হীরামনির ঘরে প্রবেশ করে। সে সময় বিপীন সাঁওতালকে নিয়ে হীরামনি ধান
বানছিলেন। পাঞ্জাবিদের দেখে তিনিও নিজেকে রক্ষা করতে ঘরে যান। তার পিছু
পিছু পাঞ্জাবিরা ঘরে প্রবেশ করে। তাদের দেখে হুশ-বুদ্ধি হারান হীরামনি।
সুঠাম দেহের দুই পাঞ্জাবি সেনা তাদের সঙ্গে মেতে উঠে উন্মত্ততায়।
ছিন্ন-ভিন্ন করে শরীর! জ্ঞান হারান হীরামনি। লালসা মিটিয়ে পাঞ্জাবিরা
তাদেরকে অচেতন অবস্থায় ফেলে চলে যায়। খবর পেয়ে বাগানের কাজ ফেলে লক্ষণ ঘরে
ফিরে দেখেন মেঝেতে পড়ে আছে হীরামনির অর্ধমৃত দেহ। শুরু করেন স্ত্রীকে সুস্থ
করার আপ্রাণ চেষ্টা। বাগানের ডাক্তারের ওষুধ আর লক্ষণের প্রচেষ্টায়
চারদিনের মাথায় জ্ঞান ফিরে আসে হীরামনির। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি।
কিন্তু পাঞ্জাবিদের যৌন নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন হীরামনি। দশ মাস
দশ দিন পর ভূমিষ্ট হয় সন্তান।
চা শ্রমিকরা সাধারণত কৃষ্ণবর্ণের। কিন্তু
হীরামনি যে বাচ্চার জন্ম দিলেন তার গায়ের রং ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। দেখতেও
অন্যরকম। শিশুটিকে দেখে সবাই বুঝতে পারলেন এটা পাঞ্জাবিদের পাপের ফসল। ধীরে
ধীরে সে বেড়ে উঠে। স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল এ নিয়ে কোনদিন কোন কথা বলেননি
তাকে। তবে এ বাচ্চার জন্য লক্ষণ সাঁওতালের পরিবারকে ঘৃণার চোখে দেখতো
বাগানের বাসিন্দারা। সমবয়সীরাও সহদেবকে টিটকারী করতো পাঞ্জাবির ছেলে বলে।
ছোট্ট সহদেব তখন বুঝতে না পারলেও বড় হয়ে সে ঠিকই সব বুঝে যায়। জেনে যায়
একাত্তরের ঘটনা। নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে তার। তবে কখনও সে তার বেদনা বুঝতে
দেয়নি মা হীরামনিকে। মাকে খুব বেশি ভালবাসতো সে। কিন্তু বুকের মধ্যে যাতনার
আগুন ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগল তার। সেই আগুন নেভাতে মদে বুদ হয়ে
থাকতো সহদেব। একদিন অতিরিক্ত মদপানে ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে।
অভিযোগ আছে, মদের বদলে অতিরিক্ত স্পিরিট খাইয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। সব
প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে যাকে এতো বড় করেছিলেন সেই সহদেব এভাবে মারা
যাবে তা তিনি ভাবতেই পারেননি। বৃদ্ধ লক্ষণ সাঁওতালও জীবনের শেষলগ্নে এসে
উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুশোক সইতে পারলেন না। এক সময় দুঃখে শোকে জীবন
প্রদীপও নিভে যায় তার।
লক্ষণ সাঁওতালের মৃত্যুতে দুই মেয়ে সহজ মনি ও
সজনীকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়লেন হীরামনি। নতুন করে শুরু হলো তার জীবনযুদ্ধ।
বেঁচে থাকার লড়াই। দুই মেয়ে ও নিজে কাজ করে সংসারটাকে টেনে নিতে শুরু
করলেন। তারা বড় হলো। তাদেরকে বিয়ে দিলেন। হীরামনি কখনও ভিক্ষের ঝুলি আবার
কখনও অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনমতে জীবন চালিয়ে নিচ্ছিলেন। বয়সের ভারে অচল
হয়ে পড়েছেন হীরামনি। অবশেষে তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার ৩ মার্চ নিজ বাড়িতে
মারা যান।
Source: http://www.dailykhowai.com/news/2016/03/04/53716/
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment