Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

এখনও জমির দাবিতে অনড় সাঁওতালরা

গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ প্রতিনিধি
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে হামলার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে সোমবার। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে পূর্বসূরিদের জমিতে চাষ করা আখ কাটতে গেলে আদিবাসী সাঁওতালদের সঙ্গে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন। এখনও সাঁওতালরা ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও বাপদাদার জমি ফেরত পাওয়ার দাবিতে অনড়।
দিনটিকে 'সাঁওতাল হত্যা দিবস' হিসেবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছে 'সাহেবগঞ্জ ভূমি উদ্ধার কমিটি'। এ উপলক্ষে স্থানীয় সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে।
গত বছরের এ হত্যা ও হামলার ঘটনার পর রামপুর গ্রামের মৌলিপাড়ার সমেশ মুর্মুর ছেলে স্বপন মুর্মু ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর অজ্ঞাতপরিচয় ৬০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া ২৬ নভেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের পক্ষে থমাস হেমব্রম স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, সাপমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল, কাটাবাড়ি ইউনিয়নের রফিকুল ইসলাম রফিকসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ৫০০-৬০০ জনের নামে থানায় মামলা করেন; কিন্তু তা আজও এজাহার হিসেবে নেওয়া হয়নি। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্ত করছে।
সাঁওতাল পল্লীতে হামলার এ ঘটনায় তিন সাঁওতাল নিহত হওয়ার পাশাপাশি পুলিশ, চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। সাঁওতালদের ঘর আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, শ্যালো মেশিন, ধান-চালসহ জমিতে চাষ করা ফসল লুটপাট করে হামলাকারীরা।
এখনও জীবনযাত্রা অস্বাভাবিক ওদের: এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের সে ঘটনা এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সাঁওতালদের। আগুনে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া আদিবাসী সাঁওতাল গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেয় ক্ষতিগ্রস্ত চার শতাধিক সাঁওতাল পরিবার। দীর্ঘদিন তারা সন্তান-সন্ততিসহ খোলা আকাশের নিচে খড়ের, ছাপরা, ত্রিপল (তাঁবু) ও কলাপাতার ঘরে দিন কাটান। অনেকে আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেন।
বিভিন্ন সময়ে একাধিক মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি পেশ, ঘেরাওসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও সাঁওতালদের জীবনযাত্রা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দা আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের রমিলা টুডু বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে খামারে তাদের প্রাপ্য জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছিলেন। হামলা ও আগুনের ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, 'ওই ঘটনার এক বছর পরও আমরা জমি ফেরত পাইনি। পাইনি স্বজন হারানোর সুষ্ঠু বিচার।'
রাজ হেমব্রম জানান, এখনও তারা নানা হুমকির মধ্যে আছেন। জমি ফেরত দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।
গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মজিবুর রহমান বলেন, 'সাঁওতালদের জীবনযাত্রা যাতে স্বাভাবিক থাকে, সে বিষয়ে পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে।'
সাহেবগঞ্জ ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাসকে বলেন, এক বছরেও বিষয়টির কোনো সমাধান হয়নি। লুটপাটের ক্ষতিপূরণ ও হত্যার সঙ্গে প্রকৃত জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির ও বাপদাদার জমির অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এদিকে, জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল সমকালকে জানান, সাঁওতালদের পুনর্বাসনে তিনটি গুচ্ছগ্রাম ও দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গুচ্ছগ্রামের কাজ প্রায় শেষ। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে জীবনমান উন্নয়নের জন্য আর্থিক সহায়তাও করা হবে।
জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল: 'সাঁওতাল হত্যা দিবস' উপলক্ষে সোমবার গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন সাহেবগঞ্জ ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাসকে।
এতে বক্তব্য দেবেন কেন্দ্রীয় ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবু সাঈদ খান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া, সিপিবির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য মিহির ঘোষ, আদিবাসি-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু, সাহেবগঞ্জ ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাহজাহান আলী প্রধান প্রমুখ।
সাপমারায় জনসভার স্থান নির্ধারণের আগে 'ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি' গোবিন্দগঞ্জ শহীদ মিনারে সমাবেশের অনুমতি চাইলেও স্থানীয় প্রশাসন তাতে সায় দেয়নি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিলাব্রত কর্মকার সমকালকে বলেন, 'জেএসসি পরীক্ষার পরিবেশ ছাড়াও সার্বিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে পরামর্শ করেই শহীদ মিনারে সমাবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং সাপমারায় সমাবেশ করতে বলা হয়েছে।'
তদন্তের সর্বশেষ পরিস্থিতি: তদন্তকারী পিবিআই সদস্যরা সম্প্রতি সাপমারা ইউপি সদস্য শাহ আলম মেম্বারকে আটক করেন। অভিযানকালে আটক শাহ আলম মেম্বারের অনুসারী জিনের বাদশা গ্রুপের সদস্যরা পিবিআই সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। এতে দুই এসআইসহ চার পিবিআই সদস্য আহত হন।
এ ঘটনার পর পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
মামলার বিষয়ে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন মিয়া বলেন, 'থমাস হেমব্রম যে অভিযোগ করেছেন, সেটি আসলে মামলা নয়; সেটি সাধারণ ডায়েরি। শুধু সাধারণ ডায়েরি করে তদন্ত ছাড়া এমন আসামি ধরা যায় না। ঘটনায় জড়িত মিঠু মিয়া নামের একজন গ্রেফতার হয়েছে। আদালতে দেওয়া তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী লুট হওয়া ঢেউটিন, ভ্যান, শ্যালোমেশিনসহ বিভিন্ন মালপত্র উদ্ধার হয়েছে। সাপমারা ইউপি সদস্য শাহ আলম গ্রেফতার হয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'একসঙ্গে তো সবাইকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়, পর্যায়ক্রমে আসামিদের ধরা হবে।'
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ক্ষেতমজুর সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওহেদুন্নবী মিলন বলেন, 'সাঁওতালদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগকারী দুই পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করা হলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। চিনিকলের কয়েক কর্মকর্তাকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেলেও তারা দিব্যি স্বপদে বহাল আছেন।'
তিনি জানান, রংপুর রেঞ্জের একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ওই ঘটনার নেতৃত্ব দেন। সাঁওতাল হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের প্রশাসন এক বছরেও গ্রেফতার করতে পারেনি।
পরিপ্রেক্ষিত: ১৯৬২ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকল প্রতিষ্ঠার সময় স্থানীয় সাঁওতালদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। যদি এসব জমিতে আখ চাষের আর প্রয়োজন না হয় বা অন্য কোনো ফসল চাষাবাদ করা হয় তবে সাঁওতালরা তাদের জমি ফেরত পাওয়ার দাবিদার হবে—এ শর্তে সেখানে এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। এর পর ২০০৪ সালে সরকার রংপুর চিনিকল বন্ধ করে দিলে জমি ফেরত পাওয়ার দাবি জানান সাঁওতালরা। এক পর্যায়ে গত বছর ৬ নভেম্বর সাঁওতাল পল্লীতে হামলা চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা হয়।

Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment