Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

সাঁওতালদের কথা শুনুন: সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম

সম্পাদকীয় ও মন্তব্য
নূরুননবী শান্ত
দ্বীজেন টুডুর চোখে গুলি লেগেছিল গত বছর ৬ নভেম্বর। বিমল কিসকুর পায়েও লেগেছিল গুলি। দ্বীজেন মোটামুটি জেনে গেছেন, চোখটা আর সেরে ওঠার নয়। দ্বীজেনের স্ত্রী ওলিভিয়া হেমব্রম ভাগ্যকে মেনে নিয়েছেন। গরিবের ভাগ্য বলতে যা হয় আর কি। 'চোখে দেখলেও যা, না দেখলেও তা!'- ওলিভিয়া বলছিলেন। কিন্তু বিমল আজও স্বপ্ন দেখেন আগের মতোই তাগদের সঙ্গে গটগট করে হেঁটে বেড়ানোর। হয়তো তার স্বপ্নই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের মাদারপুর-জয়পুরের এমন অনেক আদিবাসী সাঁওতাল শরীরে গুরুতর ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন। শ্যামল হেমব্রমের কথা বলছিলেন তারা। ৩৫ বছরের শ্যামলের বাম পাঁজরে পুলিশের গুলি লেগেছিল। শ্যামল বাঁচেনি। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। আরও একজন সাঁওতাল গুলি খেয়ে মরে পড়ে ছিল ধানক্ষেতে। মারা গেছেন মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুও। এই হত্যার বিচার হয়নি আজও। অথচ ঘটনার পরদিন থেকেই গণগ্রেফতার শুরু হয়েছিল। কারণ, তারা পুলিশের অন্যায্য কাজে বাধা দিয়েছে। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে ৪২ জন সাঁওতালের নাম উল্লেখ করে ৩০০ থেকে ৪০০ সাঁওতালের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল পুলিশ। ভয়ে সাঁওতাল পুরুষরা প্রিয় পরিবার পেছনে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। একদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসা সাঁওতালদের উচ্ছেদ করতে শত শত ঘরে আগুন দিয়েছে; আরেকদিকে স্থানীয় দুর্বৃত্তরা এই দরিদ্র আদিবাসীদের ঘরের টিন, রান্নাঘরের সামান্য বাসনপত্র, পোষা ছাগল, হাঁস-মুরগি লুট করেছে। শিশুরা ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে দেখেছে, চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে প্রিয় শোবার ঘর। ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করলেও এখন পর্যন্ত তাদের কারও বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ভূমি অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছিল বলেই তাদের এ পরিণতি।

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর পুলিশ বাগদা ফার্ম দখলমুক্ত করার নামে আদিবাসীদের কমপক্ষে ২৫০০ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। বাগদা ফার্মে আদিবাসীরা আর ঢুকতে পারে না। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা হয়েছে ফার্ম এলাকা। অন্য কোথাও কাজকর্মও এখন তেমন নেই যে, পরিবারের জন্য সাঁওতাল নারী-পুরুষ দু'মুঠো চালের বন্দোবস্ত করবে। ২৫০০ পরিবার আচমকা বাস্তুহারা হওয়ার পরও তারা সরকারি সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিল। কেননা সাঁওতালদের মনে হয়েছে, সরকার তাদের ঠকিয়েছে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে মহিমাগঞ্জে রংপুর সুগার মিল প্রতিষ্ঠা করে। মিলের জন্য ইক্ষু সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকার ১৮৪২.৩০ একর জমি The East Bengal (Emergency) Requisition of Property Act 1948 বিধান অনুসারে রিকুইজিশন করা হয়। রিকুইজিশনের চুক্তিতে বলা হয়, ইক্ষু চাষ বন্ধ হলে পূর্বের মালিকরা তাদের জমি খেসারতসহ ফেরত পাবে। ২০০৪ সালে মিল লে-অফ হলে ইক্ষু চাষ বন্ধ হয়েছিল। চুক্তির শর্তের তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা অনেকেই বাগদা ফার্মের জমি লিজ নিতে পেরেছিল। যেখানে ইক্ষু চাষ করার কথা, সেখানে ধান, তামাক ইত্যাদি আবাদ শুরু হয়। এতেই প্রকৃতির সন্তানরা ক্ষুুব্ধ হয়ে বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছিল। নিজেদের জমি ফেরত পাওয়ার জন্য তারা গঠন করে আদিবাসী-বাঙালি ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি। ইক্ষু চাষ বন্ধ হলে আদিবাসীরা ফার্মের জায়গায় ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করেন। ঘর তোলার সময় কেউ তাদের বাধা দেয়নি। বরং তখন স্থানীয় সাংসদসহ অনেকেই তাদের ভূমি অধিকারের পক্ষে কথা বলেন।

১৯৬২ সালে যখন এখানে সুগার মিলের জন্য ইক্ষুু উৎপাদনের প্রয়োজনে জমি রিকুইজিশন বিষয়ে ঢাকার হাইকোর্টে শুনানি হয়, সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন আজকের প্রবীণ আদিবাসী বান্না মুর্মু। তিনি বলেন, 'আমার মনে আছে, সে সময় আদালতে বারবার এই কথা হইছিল, কুশের (ইক্ষু) আবাদ করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই জমিজমা ব্যবহার করা যাবে না।' ২০১৫ সালে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছিল। সে সময়ের গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলেয়া খাতুন স্বাক্ষরিত এক পত্রে উল্লেখ আছে, 'আবেদনকারীদের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়।' সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী জানান, নিজেদের জমি ফেরত পেতে তারা ঢাকাতেও গিয়েছিলেন সম্প্রতি। মাননীয় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছেন, তিনি এলাকা পরিদর্শন করে আদিবাসীদের সমস্যার সমাধান করে দেবেন। আদিবাসীরা মন্ত্রীর আগমনের প্রতীক্ষায় উন্মুখ। প্রশ্ন উঠেছে, ৬ নভেম্বর পুলিশ যে আদিবাসীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল, গুঁড়িয়ে দিল, তাদের কাছে কি কোর্টের কোনো নির্দেশ ছিল? পুলিশ কোন ক্ষমতাবলে এতটা অমানবিক অপারেশন চালাল? আদিবাসীরা বলছে, 'আমাদের কাছে অনেক কিছু গোপন করা হচ্ছে। জমি ফেরত না পাইলে আমরা বলব, আমাদের গুলি করে মারে ফালান।' শাহজাহান আলী আরও বলেন, 'আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, সরকার এড়ে-কাটে চলতিছে। তবে বাগদা ফার্মের সমস্যা সমাধান না করলে এখানকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।'

গত ১০ অক্টোবর আমরা যখন গোবিন্দগঞ্জের সাতমারা ইউনিয়নে আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে যাই, তখন এক বাঙালি তরুণ বলেন, 'ক্ষমতাবানদের আসল দৃষ্টিভঙ্গি হলো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা! এত গোয়েন্দা পুলিশ থাকতেও সরকার কি জানে না কীভাবে কী ঘটল?' সাঁওতালরা বলেছেন, 'আমাদের জমিগুলো চোখের সামনে অন্যেরা লিজ নিয়ে আবাদ করবে, প্রভাবশালী কেউ আবার ফুর্তি করার পার্ক বানাতে চাইবে, সরকার আগের শর্ত পূরণ না করেই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা করবে; আর আমরা কিছুই জানতে পারব না- এটা কেমন কথা!' বেশ কয়েকজন আদিবাসী জানান, 'সরকার কাটাবাড়ি, ফুলহার, বোগদহ এলাকা মিলে আশ্রয়কেন্দ্র বানাবি। সেখানে ৩০০ সাঁওতাল পরিবার আশ্রয় পাবি। এইটা আদিবাসীদের সম্পূর্ণ ভূমিহীন প্রমাণ করার একটা চক্রান্ত।' ২৪ অক্টোবর বগুড়ার দৈনিক করতোয়ার প্রথম পাতার একটি খবর থেকে জানা যায়, সেনাবাহিনীকে সেখানে একটি ব্যারাক নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সরকার আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা না করায় এটি একটি একতরফা সিদ্ধান্তে পরিণত হয়েছে। যাদের কল্যাণের কথা সরকার ভাবছে, তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা জেনে না নেওয়ায় সরকারের এ সিদ্ধান্ত আদিবাসীরা তাদের ঠকানোর আরেকটি কৌশল মনে করছে।

গোবিন্দগঞ্জের পাঁচটি মৌজা নিয়ে বাগদা ফার্ম গড়ে উঠেছিল- মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ, চক রহিমাপুর, রামপুরা ও সাতমারা। এখানকার বর্তমান আনুমানিক জনসংখ্যা ৩০ হাজার, যার ৭০ ভাগ আদিবাসী, ২০ ভাগ মুসলমান ও ১০ ভাগ হিন্দু। ইক্ষুর মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে প্রধানত এই জমিগুলোর ওপর নির্ভর করেই এতকাল জীবনধারণ করেছে এখানকার অধিবাসীরা। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আগে আগে জমিদার অখিল চন্দ্র ১৬০০০ একর জমি আদিবাসীদের পত্তন দিয়েছিলেন। তারই অংশবিশেষে চিনিকলের জন্য ইক্ষু খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। অখিল চন্দ্রের হিসাব দেখাশোনা করতেন একজন আদিবাসী, যার নাম বাগদা সরেন। তার নাম অনুসারেই এই বাগদা ফার্ম।

গোবিন্দগঞ্জ তথা গাইবান্ধা জেলার মানুষ ৬ নভেম্বরের বিভীষিকার কথা কোনোদিন ভুলবে না। শিশুরা মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে বেড়াবে এই দুঃস্বপ্ন। দিনটি স্মরণে এ বছর সমাবেশ করতে যাচ্ছে তারা। ঢাকা থেকেও মানবাধিকার কর্মীরা সেখানে যাবেন বলে জানা গেছে। গাইবান্ধা জেলার মানবাধিকার কর্মী কাজী আবদুল খালেক বলেন, 'সরকারের উচিত কালবিলম্ব না করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও আদিবাসীদের নিয়ে কার্যকর আলোচনায় বসা এবং বাগদা ফার্মকে ঘিরে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা।'

আদিবাসীরা জানায়, তাদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই সরকারসহ অন্যান্য প্রভাবশালী মহল সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের জমিতে নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে। এসব কারণেই এখানে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সহিংসতায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে হাইকোর্টের আদেশে একটি জুডিসিয়ারি ইনকয়ারি হয়েছে মাত্র। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ এক বছরেও দৃশ্যমান নয়। ফলে কিছুদিন পরপরই ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে। যারা স্বজন হারিয়েছে, যারা আহত শরীরের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে তাদের বেদনা, ক্ষোভ ও দাবিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। শিগগিরই এ পরিস্থিতি সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এখানকার সাঁওতালসহ সব নাগরিক আরও সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়বে।

santonabi@yahoo.com

জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
উৎস: http://samakal.com/todays-print-edition/tp-editorial-comments/article/17111046/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%93%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%A8
Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment