Place for Advertisement

Please Contact: spbjouralbd@gmail.com

শহীদ মহিষাসুর

- ছন্দক চট্টোপাধ্যায়
টবেলা থেকেই ‘মেঘনাদ বধ’ আমার প্রিয় কাব্যি । লালকমল নীলকমলের খোক্কসগুলো ভারী প্রিয় । কী ঐশ্বর্য আছে রাজকুমারিতে যত আছে ঠাকুমার ঝুলির দত্যি দানোয় । মহালয়াও যখন টিভিতে দেখেছি পক্ষ নিতে ইচ্ছা করেছে রক্তবীজের । ওরে বাবা রে, সে কি কাণ্ড । একফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লেই পুনর্জন্ম । সে জায়গায় ভো-কাট্টা দুর্গা । আর চিরকালই দেবতাদের চোর চোট্টা মনে হয়েছে। অসুরগুলো ধ্যান জপে বসবে, তাদের ধ্যান ভঙ্গ করতে মেনকা,উর্বশীদের লেলিয়ে দেওয়া হবে । দুই পক্ষ মিলে সমুদ্র মন্থন করে অমরত্বের ভাণ্ড সংগ্রহ করবে, দেবতারা ছল করে অসুরদের তা পান করতে দেবে না । এগুলো কী ? এতো পাড়ার ক্রিকেটের মতো, আমি বড় লোকের ব্যাটা, আমার ব্যাট বল তাই আমি আউট হলেও আউট নয় । তাই বুকের ধন আমার মেঘনাদ বধ । পাষণ্ড, জাতিবিদ্বেষী, পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ ফ্যাসিস্ট রামের পরাজয় । সমগ্র পুঁজিবাদের মধ্যে একখণ্ড সমাজবাদ যেন ।

তাই মহিষাসুরের শহীদদিবস আমায় উৎফুল্ল করেছিলো । মহালয়ার দিন শুভ শারদীয়ার মেসেজের জবাবে আমি লিখেছিলুম, ‘আমায় এই মেসেজ পাঠিও না, আমি বীর শহীদ হুদুর দুর্গার পক্ষে’। পৌঁছতে পৌঁছতে উৎসব খতম হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু বীরদর্পে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মহিষাসুর । গোটা পশ্চিমবঙ্গ যখন ‘দেবী বন্দনায়’ মাতোয়ারা তখন পুরুলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় ‘মহিষাসুর স্মরণ দিবস’। অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক চেরিয়ান মাহাতো, অজিত হেমব্রমদের সাথে কথা বলে জেনেছি, ২০১১ থেকে ‘শিকর দিসম খেরওয়াল বীর লাকচার কমিটি’র পরিচালনায় এঁরা এই অনুষ্ঠানটি সংগঠিত করছেন। অনুষ্ঠানটির নাম সচেতন ভাবেই শহীদ দিবস, অসুর পুজো নয় । কারন ওনারা মনে করেন ‘পুজো’র মধ্যে একটা অলৌকিকের উপাসনার ব্যাপার আছে, এই দর্শনের সঙ্গে তারা একমত নন । অসুর তাদের পূর্বপুরুষ, এবং এক যুদ্ধে তিনি নিহত হয়েছিলেন, তাই তিনি বীর শহীদ ।

খেরওয়াল আদিবাসীদের মধ্যে বিশেষত সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাঁও প্রভৃতি জনজাতির মানুষেরা ষষ্টী থেকে দশমী পর্যন্ত নারী পোষাক পরে দলবদ্ধভাবে ‘দাঁশাই’ নাচ করে। আবার কুড়মি কোবিলার জন-গোষ্ঠী এবং কোড়া কোবিলার, বাউরী, সহিস, মুদি প্রভৃতি ভূমিপুত্ররা একইভাবে নারী পোষাক পরে দলবদ্ধভাবে ‘কাঠি নাচ’ করতে করতে গ্রামে-গ্রামে ভিক্ষা করে বেড়ায়। যদিও এই কটা দিন ছাড়া খেটে খেতেই তারা পছন্দ করেন এবং ভিক্ষাবৃত্তি পাপ বলেই মনে করেন । ‘দাঁশাই’ নাচ ও ‘কাঠি নাচ’কে দূর্গোৎসবের স্বপক্ষে আদিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বলে অনেক কাগজে প্রচার করা হয়ে থাকে কিন্তু ওনাদের বক্তব্য সেটি একেবারেই ভুল। পূজোর মাসটিকে এরা ‘দাশাঁইমাস’ বলে থাকেন অর্থাৎ দু:খের মাস । আদিবাসীদের আদিপুরুষ হুদুরদুর্গা ঘোরাসুর তথা মহিষাসুর বিদেশী আর্য নারী দ্বারা নিধনের ফলে ভূমিপুত্র আদিবাসীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা হারিয়েছিল।

মহালয়ার মেলোড্রামায় যেমন দেখানো হয়, অসুর আ হা হা হা…একজন নারী, একজন নারী নাকি আমায় হত্যা করবে বলে তিড়িং বিড়িং করে নাচছে । বিষয়টি ঠিক তেমন নয় । আসল কথা হল আদিকালে যুদ্ধের কতকগুলো রুল বীর যোদ্ধারা ফলো করতেন । যেমন যোদ্ধা ছাড়া কারু গায়ে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হবে না । নারী এবং শিশুদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে না । সূর্য ডুবে গেলে অস্ত্র সম্বরন করতে হবে । যার একটি আইনও মানেননি ‘মহারথি’ বলে  পরিচিতরা।  নাহলে কোনদিনই ভীষ্মকে হারাতে পারতেন না কাপুরুষ অর্জুন । রথের সামনে তিনি সেদিন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শ্রীখণ্ডী কে খাড়া করেছিলেন যাতে ভীষ্ম অস্ত্রের ব্যবহার না করতে পারেন । মহামহিম ভীষ্ম অস্ত্র না ধরলেও অর্জুন তা করতে কসুর করেননি । বান বর্ষণে ধরাশায়ী করে সে কি বাবা গো মা গো ন্যাকা কান্না । মহাভারতে এভাবেই কোতল করা হয়েছিলো জয়দ্রথকে । সূর্য ডোবার ভান করিয়েছিলেন কৃষ্ণ । এনারা বাপের ব্যাটাও নন । পাড়ার বেচু মস্তান অন্তত দু চার খিস্তি আউরে বলে আয় কে আছিস সম্মুখ সমরে । ছিঃ । তো যা বলছিলাম ঘটনা হলো  মহিষাসুর বীরবিক্রমে আকাশ পাতাল এক করে ফেলেছেন, কোন বিদেশি যোদ্ধাই ভারতের আদিবাসী নেতা কে হারাতে পারছেন না । তখন ছল করে একজন মেয়েকে পাঠানো হয় । কোন মেয়েকে যুদ্ধে পাঠালে অসুর অস্ত্র ধরবেন না, সেই ফাঁকে তাকে খতম করা হবে । এই ছিল ফন্দি । তাই হয়েছিলো । আর্যপক্ষ যখন ছল চাতুরি করে, বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল সেই সময় আদিবাসীরা বশ্যতা স্বীকার না করে মান বাঁচাবার উদ্দেশ্যে নারী ছদ্মবেশে ‘দাঁশাই’ নাচ ও ‘কাঠি নাচ’-এর মাধ্যমে সিন্ধু পাড় ছেড়ে আসাম, বঙ্গদেশ ও দক্ষিণ ভারতের বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেয় । মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বাসিন্দা হিসাবে তাদের ধারনা ছিল তারা যেহেতু কোন নারীর গায়ে হাত তোলেন না, তেমনই নারীর ছদ্মবেশ ধরলে তারাও বেঁচে পালাতে পারবেন কিন্তু সেই পথে বহু মহিলাকে লাঞ্চিত হতে হয় আর্যদের হাতে।
এই ঘটনার স্মরণেই আজও আদিবাসী পুরুষরা মেয়েদের পোশাক পরে বুক চাপড়ে হায় হায় বলতে বলতে দশাই নাচ নাচেন । সরকার স্বীকৃত ৪০টি শিডিয়ুল ট্রাইব গোষ্ঠীর মধ্যে একটির নাম ‘অসুর’ সেকথাই এই বাংলার অনেকে জানেন না ।

আর একটা গল্পের কথা কোথাও কোথাও শোনা যায় । কোন ইতিহাস পাঠ্যে এটি নথিভুক্ত নয়, কিন্তু গানে- লোকাচারে- উৎসবে শোনা যায় । যে বৃদ্ধা কখনও ইস্কুলের চৌকাঠে পা দেননি তার স্মরণে অমলিন । প্রাচীনকালে এই দেশের নাম নাকি ছিল ‘বোঙ্গাদিশম’ । যার সম্রাট ছিলেন বোঙ্গাসুর বা মহিষাসুর । হুদুর শব্দের অর্থ বজ্র ধ্বনি । বজ্রের মতো প্রতাপ যার তার নাম ছিল হুদুর দুর্গা । মহাতেজ এই রাজার কাছে আর্যরা পর্যুদস্ত হন । কোনভাবেই যখন বোঙ্গাদিশম জয় সম্ভব হচ্ছে না তখন স্বর্গের অপ্সরা মেনকা কন্যা দুর্গাকে মহিষাসুর বধে পাঠানো হয় । কথিত আছে আর্যরা ভারতীয় আদিবাসী রাজাদের পরাজিত এবং নিহত করবার পরে তাদের স্ত্রী এবং নারীদের নিজেদের দুর্গে নিয়ে গিয়ে যথেচ্ছ যৌন নিগ্রহ করে তাদের দাসী বা নর্তকী তে পরিনত করতো । লক্ষ করুন, কোডগুলি, যেমনভাবে আমরা দেখেছি হারেম গড়ে উঠছে বিভিন্ন সম্রাটের প্রাসাদে তেমন করেই কিন্তু পতিতালয় তৈরি হয়েছিলো স্বর্গে (আর্যদের বাসস্থান)। পরবর্তী কালে এই সব হতভাগীকেই যুদ্ধের প্রকৌশল হিসাবে ব্যবহার করা হত । দুর্গাও তেমনই এক নারী । দেবতাদের (আর্য) পতিতালয়ে তিনি থাকতেন, তিনি প্রেমের ছলনা এবং যৌন সংসর্গ করে সুযোগ বুঝে মহিষাসুর কে হত্যা
করেন।
আজ আমরা বাপের মৃত্যুতে তা থৈ নাচছি । মহিষাসুর কি মোষরূপী অসুর ? বেশীর ভাগ মানুষ সদর্থক উত্তর দেবেন । আসলে যেমন করে ঢাক ঢোল পিটিয়ে কারণবারি খাইয়ে
সতীদাহকে লেজিটিমেট করা হয়েছিলো । তেমন করেই ঢাক বাদ্যি পিটিয়ে ধূপ ধুনো দিয়ে এক ইতিহাস  বিস্মরণের চক্রান্ত রচনা করেছেন বামুনরা । তারপর বেতার যন্ত্রের সহযোগিতায় একটা ফ্যান্টাস্টিক ক্যাম্পেনের মাধ্যামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অশুভের নাশ কে । নতুন করে আজ একটা দাবী খুব জোরের সাথে উঠছে, আদিবাসী মানুষরা তুলছেন । তাদের বীর যোদ্ধা কে দুর্গার পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, কোন মূর্তিতে অসুর কে তারা নতজানু দেখতে রাজি নন । কারু ভাবাবেগে তারা আঘাত করতে চান না, কেউ যদি দুর্গা উপাসক হন,তিনি কেবলমাত্র দুর্গা মূর্তির পূজা করুন, কিন্তু পায়ের তলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক অন্য এক তিলকা মাঝি, সিধু কানহু কে…
Source: http://agamikal.com/?p=855


 

Share on Google Plus

About Santali Pạrsi

0 comments:

Post a Comment