প্রামাণ্য ইতিহাসে তাঁর নাম নেই। কিন্তু সাঁওতালদের লোকশ্রুতি অনুযায়ী তিনিই জঙ্গলখণ্ডের বীরযোদ্ধা-শেষ রাজা ‘হুদুরদুরগা’। সুদূর অতীতে জঙ্গলমহলের মূলবাসী এই রাজার শোকে এখনও বার্ষিক শোকপালন করেন সাঁওতাল সম্প্রদায়। বলা হয়, পরাক্রমী আদিবাসী রাজা হুদুরের বিনাশকে ঘিরেই এখানে আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। সাঁওতাল সমাজের জনশ্রুতি, ‘দেবাংশী’ আর্যরা কৌশলে হুদুরকে হত্যা করে দখল করেছিল সমগ্র জঙ্গলখণ্ড। তারপর থেকেই চরম অত্যাচারিত মূলবাসীরা নিজভূমে পরবাসী হয়ে যান। এক সময় এলাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার কারণেই কী সাঁওতাল সমাজের একাংশ এখনও ভীষণ রকম আত্মকেন্দ্রিক? তথাকথিত উচ্চবর্ণের ছোঁয়াচ থেকে নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্যই কী আদিবাসী সমাজের মধ্যে এত আগল? এত সামাজিক বিধিনিষেধ? উত্তর খুঁজছেন জঙ্গলমহলেরই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের যুবক সুমন্ত মুর্মু। বছর তিরিশের সুমন্তের বাড়ি ঝাড়গ্রাম শহরের উত্তর বামদায়। তবে রাজ্য বিদ্যুত্‌ বন্টন সংস্থায় চাকরির সূত্রে থাকেন পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে।
[তথ্যচিত্রের একটি দৃশ্যে হুদুরের ভূমিকায় সুমন্ত মুর্মু।— নিজস্ব চিত্র।]

সুমন্তর ছোটবেলা কেটেছে বেলপাহাড়ির পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ঠাকরানপাহাড়ি গ্রামে। ফলে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষজনের জীবনযন্ত্রণার বারোমাস্যা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। পরে সমাজবিজ্ঞানের স্নাতক হয়ে নিজের সম্প্রদায়ের শিকড় সন্ধানে গত পাঁচ বছর ধরে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ করে চলেছেন। সেই নিরিখেই সুমন্ত ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। ‘হি ওয়াজ় নট এ ডেমন, হুদুরদুরগা: এ গ্রেট ট্র্যাইবাল কিং’ শিরোনামে দশ মিনিটের তথ্যচিত্রটিতে হুদুরের ভূমিকায় অভনয় করছেন সুমন্ত নিজে। মুখ্য প্রযোজক ও পরিচালকও তিনি। বেলপাহাড়ির পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে বেশ কিছু দৃশ্যগ্রহণের কাজ হয়ে গিয়েছে। আগামী বছরের গোড়ায় ইউটিউবের মাধ্যমে সাঁওতালি ও ইংরেজি দ্বিভাষিক এই তথ্যচিত্রটি দেখতে পাবেন দর্শকরা। সুমন্তর কথায়, “আদিবাসী সংস্কৃতিকে আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদেই তথ্যচিত্রটি বানাচ্ছি। একদিকে সাঁওতাল সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসের কথা থাকছে। অন্যদিকে, যুক্তি দিয়ে মুক্ত চিন্তা-চেতনার পক্ষে কিছু সওয়ালও করা হবে।” বছর খানেক আগে এক বন্ধুর ক্যামেরা ধার করে প্রথমবার একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন সুমন্ত। ইউটিউবে ওই তথ্যচিত্রটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এবারও বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে তথ্যচিত্রের কাজ শুরু করেছেন তিনি। পরে কিনে নিয়েছেন একটি ক্যামেরাও। সুমন্তের টিমে রয়েছেন পেশায় ডাক বিভাগের কর্মী সুশান্ত টুডু, প্রাথমিক পার্শ্বশিক্ষক প্রদীপ মুর্মু, বেসরকারি সংস্থার কর্মী জোনা মাণ্ডি, কৃষ্ণ মুর্মু, বিদ্যুত্‌ দফতরের কর্মী শতদল সাঁতরা, প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক জয়ন্ত সিংহ-রা।
কিন্তু হঠাত্‌ করে কেন এমন একটি বিষয়কে নির্বাচন করলেন? সুমন্ত জানাচ্ছেন, হাজার বছর ধরে নিজেদের আদবাসী সমাজকে স্বতন্ত্র করে রাখার ফলে বাইরের মুক্ত চিন্তাধারার সঙ্গে পারস্পরিক তুল্যমূল্য বিচারের সুযোগ ততটা নেই। যে কারণে গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের সংস্কার ও প্রথাকে আঁকড়ে রয়েছেন একটি অংশ। ফলে, শিক্ষিত প্রজন্মের একাংশের মনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। তাই নিয়ে রক্ষণশীল ও চিন্তাশীলদের মধ্যে যুক্তিসংঘাত বাধছে। এখনও আদিবাসী সমাজে শিক্ষার হার আশানুরূপ নয়। আধুনিক চিকিত্‌সা বিজ্ঞানের যুগেও ওঝা, ঝাড়ফুঁক, গুণিন নির্ভর সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটানো যায়নি। বাল্যবিবাহ-সহ নানা কুপ্রথার বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো যায়নি। এই আবহে পরাক্রমী রাজা হুদুরদুরগার কাহিনি দিয়েই নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে চান সুমন্ত। সুমন্তর কথায়, “কেন আমরা এখনও অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি, সেই বিশ্লেষণও থাকবে তথ্যচিত্রে। থাকবে এগিয়ে চলার বার্তাও।”
ঝাড়গ্রাম মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক আজিজুর রহমান বলেন, “সুমন্তবাবুরা তথ্যচিত্রটির কাজ শুরু করেছেন বলে শুনেছি। তথ্যচিত্রটি ইউটিউবে দেখার জন্য
অপেক্ষায় রয়েছি।”